মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
লায়লাতুল কদর : মহিমান্বিত রজনী
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুলাই ২০১৫, ৪:২৩ পূর্বাহ্ণ
আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মোহাম্মদির জন্য যতগুলো নিয়ামত দান করেছেন তার মধ্যে লায়লাতুল কদর অন্যতম ও শ্রেষ্ঠতম। এই রাতটি এমন একটি বৈশিষ্ট্যময়, মহিমান্বিত রাত যার মান-মর্যাদার বিবেচনায় এর সমকক্ষ অন্য কোনো রাত হতে পারে না। এই রাতের এ মহত্ত্বের কারণ একটাই, আর তা হলো- মানব জাতির হেদায়েতের বাণী ঐশী গ্রন্থ আল কোরআন এ রাতেই অবতীর্ণ হয়েছে। যার মাধ্যমে মৃতপ্রায় পৃথিবী পুনর্জীবন লাভকালে শতাব্দীর নিকশ কালো ধূলির আস্তরণে চাপা পড়া মানবতা জেগে উঠেছে নতুন প্রেরণা নিয়ে। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে সে জাহেলি যুগের অবসান ঘটিয়ে কোরআনভিত্তিক একটি নতুন জাতি উপহার দিয়েছিল। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আমি এ কোরআন কদর (সম্মানিত) রাত্রিতে নাজিল করেছি। তুমি কি জান কদর রাত্রি কি? কদর হাজার রাতের চেয়েও উত্তম’। এ রাতে ফেরেশতারা ও জিব্রাইল (আ.) রহমত, বরকত ও শান্তি নিয়ে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হন। তারা এভাবে বলতে থাকেন, শান্তি এভাবে প্রভাত উদয় হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে। প্রশ্ন আসতে পারে সব দিন-রাতই তো আল্লাহর, তাহলে আলাদা করে একটাকে এত গুরুত্ব কেন? আর এর কারণ একটাই আর তা হলো আল কোরআন। আকাশের নিচে জমিনের ওপর কোরআনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নেই। এ গ্রন্থের মাধ্যমেই আমরা আল্লাহর অনুপম পরিচয় লাভ করেছি, মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জানতে পেরেছি। ইহজগতের সব কর্মের জবাবদিহিতার প্রতি আমাদের সতর্ক করেছে আল কোরআন। এক কথায় কোরআনই হলো মুমিন জিন্দেগির একমাত্র গাইডবুক। তাই এমন মহিমাম্বিত ঐশী গ্রন্থ যে রাতে নাজিল হবে, তা হাজার রাতের চেয়ে উত্তম হবে এটাই যুক্তিযুক্ত।
লায়লাতুল কদর অর্থ মাহাত্ম্যপূর্ণ ও মহিমান্বিত রাত। ‘লায়ল’ আরবি শব্দ, এর অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান। লায়লাতুল কদর শবে কদর নামেও পরিচিত। ‘শব’ ফার্সি শব্দ, এর অর্থ রাত। ফলে লায়লাতুল কদর আর শবে কদর মূলত একই অর্থ বহন করে। পবিত্র কোরআনে শবে কদরকে ‘লায়লাতুম মুবারাকাতুন’ বলেও পরিচিত করা হয়েছে। এ রাত ঈমানদার মুসলমানের জন্য বয়ে নিয়ে আসে বরকতের ফল্গুধারা। লায়লাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ।
শবেকদরের রাত কোনটি তা সম্পর্কে হাদিসে সরাসরি কোনো নির্দেশনা নেই। সেজন্য রমজানের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করতে হয়। তাহলে শবেকদর পাওয়ার একটা নিশ্চয়তা থাকে। রাসূল (সা.) শবেকদরের তালাশের জন্য এতেকাফ করতেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাত্রিতে শবেকদরকে তালাশ কর’। শবেকদরের রাত নির্ণয়ে একাধিক মত থাকলেও হজরত উবাই (রা.) দৃঢ়তার সঙ্গে শপথ করে বলেছেন যে, এটা ২৭-এর রাতে। ইমাম আহমদ (র.) এরও একই মত। অধিকাংশ সাহাবা ও ওলামাদের মতে, শবেকদর শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাত্রিতে; বিশেষত ২৭ রমজান। এর সমর্থনে অনেক হাদিস রয়েছে।
কেবল উম্মতে মোহাম্মদিকেই এ রাতটি প্রদান করা হয়েছে। হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) তার পূর্ববর্তীদের দীর্ঘ আয়ু ও এবাদত দেখে স্বীয় উম্মতের জন্য চিন্তিত হলেন। তখন আল্লাহ তায়ালা সূরা কদর নাজিল করে জানিয়ে দিলেন, আপনার উম্মতদের অধিক হায়াত পাওয়ার প্রয়োজন নেই। তারা অল্প হায়াতের মধ্যেই অন্যান্য নবীদের উম্মতদের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জন করতে পারবে।
কদর শব্দের অর্থ তকদির। এ রাতে পরবর্তী এক বছরের জন্য ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিজিক, বৃষ্টি, হজ প্রভৃতি সব কিছুর পরিমাণ লিখে দেয়া হয়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ইসরাফিল, মিকাইল, জিবরাইল ও আজরাইলকে (আ.) লিখিত নির্দেশ এ রাতে হস্তান্তর করা হয়। অধিকাংশ তাফসিরবিদ মনে করেন, তকদির সংক্রান্ত বিষয়াদির প্রাথমিক ফয়সালা শবে বরাতেই হয়ে থাকে। তবে এর বিশদ বিবরণ শবে কদরে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব উপরোক্ত ফেরেশতাগণের কাছে এ রাতে অর্পণ করা হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সঙ্গে শবেকদরের রাতে মহান আল্লাহর এবাদতে নিমগ্ন থাকবে, আল্লাহপাক তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন’ (বোখারি)। ঈমান হচ্ছে মহান আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস এবং অবিচল আস্থা। আর ইহতিসাব হচ্ছে সওয়াবের আশা ও পুণ্য অন্বেষণ। অতএব যে ব্যক্তি মহামহিম আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা রেখে সওয়াবের আশায় ও অন্বেষায় কদরের রাতে এবাদতে মশগুল থাকবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অবশ্যই তার ভাগ্যে উপরোক্ত বরকত নাজিল করবেন।
শবেকদরে যে ব্যক্তি এবাদত করার সৌভাগ্য অর্জন করে সে সীমাহীন বরকত ও কল্যাণ লাভ করবে। এমনকি সে ৮৩ বছর ৪ মাস এবাদতের চেয়ে অধিক সওয়াবের অধিকারী হয়। হজরত আয়শা (রা.) বলেন, আমি নবী করিম (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসূল আমি যদি শবেকদরের রাত পাই তাহলে কি দোয়া পড়ব। রাসূল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউয়ুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী’ পবিত্র রজনী শবেকদরের যথাযথ মূল্যায়ন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]