মৌলভীবাজারে প্রয়োজনীয় পোশাক, সরঞ্জাম ছাড়াই বাগানে কীটনাশক ব্যবহার
রোগাক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার চা শ্রমিক
প্রকাশিত হয়েছে : ৮ জুলাই ২০১৫, ১:২৫ অপরাহ্ণ
জয়নাল আবেদীন, কমলগঞ্জ ::
মৌলভীবাজারের ৯২ টি চা বাগানে তরল কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে। চা গাছের রোগব্যাধি নিবারণ, পোকামাকড় দমন ও ঘাস মারার জন্য ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার করছে বাগান কর্তৃপক্ষ। কোন ধরনের মুখোশ ও ড্রেস পরিধান ছাড়াই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কীটনাশক ব্যবহারের ফলে রক্ত দূষণ, কিডনি, হৃদরোগ, চর্মরোগসহ নানারোগে আক্রান্ত হচ্ছে চা শ্রমিকরা। সম্প্রতি বিভিন্ন চা বাগানে শ্রমিকরা এ বিষয়ে সোচ্চার হয়ে উঠলে বাগান কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু বাগানে চশমা ও পোশাক প্রদান করছে।
চা শ্রমিকদের অভিযোগে বিভিন্ন বাগানে অনুসন্ধান চালিয়ে এসব চিত্র পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চা বাগানে ঘাস ও বিষাক্ত পোকা-মাকড় দমন এবং চা গাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য নিয়মিতহারে উডিসাইট, গ্রামাক্সন, কারমেক্স, থাইডন, ফাইরোপক্স, ইথিওন, সোপারভিট, কোপ্রাভিট ইত্যাদি বিষাক্ত কীটনাশকের সাথে রাসায়নিক সার মিকচার করে চায়ের টিলাভূমিতে প্রয়োগ করা হয়। মৌলভীবাজারে ডানকান, ফিনলে, ইস্পাহানি, এনটিসি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ৯২টি চা বাগানে শ্রমিকরা কীটনাশকের সাথে রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে প্রতি বছর চা শ্রমিকরা ভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
শ্রম আইন ২০০৬ এর ৭৯ ধারার (ঘ) ও (ঙ) উপধারায় মুখোশ, চশমা, গ্লাবস, গাউন, বুট জোতাসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি প্রদান এবং পূর্বে নোটিশ দিয়ে সতর্কতার সহিত কাজ করানোর কথা রয়েছে। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করেই চা বাগানের শ্রমিকদের অসচেতনতার কারনে যুগ যুগ ধরে বাগান কর্তৃপক্ষ কীটনাশক প্রয়োগকারী শ্রমিকদের এসব সরঞ্জাম না দেয়ায় শ্রমিকরা খালি গায়ে কীটনাশক প্রয়োগ করে চলেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমলগঞ্জের ডানকান ব্রাদার্সের কয়েকজন শ্রমিক বলেন, ‘চা বাগানে দীর্ঘদিন যাবত ঘাস মারার ঔষধ দেই। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত ঔষধ দিতে হয়। পায়ে শুধু প্লাস্টিকের সেন্ডেল আর কিছুই দেয়া হয় না। স্প্রে মেশিনে ১৬ লিটার ঔষধ নিয়ে টিলায় উঠে কাজ করতে হয়। একজন শ্রমিকে এক একর জায়গায় ঔষধ স্প্রে করতে হয়। হাত দিয়ে ঔষধ মিকচার করে স্প্রে করার পর ৫/৭ বার সাবান দিয়ে ধুইলেও গন্ধ যায় না। বমি বমি ভাব করে। খাওয়ার রুচি হয় না। চোখে জ্বালা পোড়া করে, চোখ লাল হয়। লম্বরের ভিতরে হাঁটতে হাঁটতে লজ্জাবতির কাটার আঘাত পেলে পরে কীটনাশক লেগে ঘাঁ হয়। অনেক সময় পেটও ফুলে যায়। ঘুমে সমস্যা হয়। কীটনাশক দেয়ার কারণে মাত্র ২ টাকা ঝুঁকি ভাতা দেয়া হয়।’
ডানকান ব্রাদার্স শমশেরনগরের শ্রমিক নেতা ও ইউপি সদস্য সিতারাম বিন বলেন, চা বাগানে যে পরিমাণ কীটনাশক শ্রমিকরা অপরিকল্পিতভাবে স্প্রে ও মিক্সিং করে, তাতে সারা বছরই ওই শ্রমিকদের নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকে। বারবার বাগান কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেয়ার কথা বললেও বাগান কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করছে না। এতে শ্রমিকরা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাগান কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি কিছু কিছু বাগানে আংশিক সরঞ্জামাদি প্রদান করছে।
মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের কনস্যালটেন্ট ডা. স্বপন কুমার সিংহ বলেন, চা বাগানে যেসব কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে তাতে চা শ্রমিকদের রক্ত দুষণ, কিডনি, হার্টডিজিজ, চর্মরোগসহ নানারোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এমনকি ব্লাড ক্যান্সার হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। এইসব কীটনাশকের প্রভাবে অনেকরই আত্মহত্যার প্রবনতা বেড়ে যায়। তাদেরকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে।
এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় চা বাগান ব্যবস্থাপকরা উর্দ্ধতন অফিসের অনুমতি ছাড়া কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহকারী ব্যবস্থাপক বলেন, সম্প্রতি সময়ে শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় পোশাকাদি প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া কীটনাশক প্রয়োগকারী শ্রমিকরা ইচ্ছে করেই এসব ড্রেস পরিধান করেন না।