বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ
আশিভাগ শিশুদেরই মা-বাবাসহ অভিভাবকেরা মারধর ও মানসিক চাপ দিয়ে শৃঙ্খলা শেখান
প্রকাশিত হয়েছে : ৬ জুলাই ২০১৫, ৩:১৪ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
শাসন করে শৃঙ্খলা শেখাতে গিয়ে বাংলাদেশে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশকে মারধর করেন মা-বাবাসহ অভিভাবকেরা। আর ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিশুকে মানসিক চাপ দিয়ে শৃঙ্খলা শেখানো হয়। এতে শিশুদের ওপর সাময়িক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে।
বহুমাত্রিক সূচক নির্ধারণে পরিচালিত গুচ্ছ জরিপ—মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) ২০১২-১৩তে এ চিত্র পাওয়া গেছে। ইউনিসেফের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জরিপটি করেছে। গতকাল রোববার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জরিপের ফলাফল নিয়ে প্রগতির পথে নামে একটি বই প্রকাশ করা হয়।
বিবিএস বলছে, শৃঙ্খলা বলতে শিশুদের পড়াশোনায় মনোযোগী করা, সঠিক সময়ে খাওয়াসহ অভিভাবকদের বিভিন্ন নির্দেশনা অনুযায়ী কাজকে বোঝানো হয়েছে। আর শৃঙ্খলা আনতে মা-বাবারাই বেশি শাসন করেন। সাধারণত বাসায় ও বিদ্যালয়ে এমন শাস্তি দেওয়া হয়।
জরিপে দেখা গেছে, প্রতি তিনজন মায়ের মধ্যে একজন বিশ্বাস করেন, নিয়মকানুন শেখাতে সন্তানদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়, এমন শাস্তি শিশুর উন্নয়ন, শেখার সক্ষমতা ও স্কুলের পারদর্শিতা বাধাগ্রস্ত করে।
৬৪টি জেলায় এ জরিপ করা হয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে ৫৯ হাজার ৮৯৫টি পরিবার থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এতে ৭৫ হাজার ৯০৭টি শিশুর অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নেওয়া হয়।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, শাসন করতে গিয়ে ৬৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুকে কোনো না কোনোভাবে মারধর করা হয়। এর মধ্যে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুকে শারীরিকভাবে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। বিবিএসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কঠোর শাস্তি বলতে এখানে বেত্রাঘাত বা এ ধরনের আঘাতকে বোঝানো হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি মারধর করা হয় তিন-চার বছরের শিশুদের, ৭৩ দশমিক ৬ শতাংশ। মারধরের প্রবণতা শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। গ্রামে ৬৭ দশমিক ১ শতাংশ, আর শহরে ৬০ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু। সবচেয়ে বেশি মারধর করা হয় খুলনা বিভাগের শিশুদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিন-চার বছর বয়স থেকে শিশুদের মধ্যে স্বাধীনচেতা মনোভাব তৈরি হতে শুরু করে। তারা সবকিছু ভেঙেচুরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে চায়।
মারধর করলে শিশুরা ভবিষ্যতে আচরণগত সমস্যায় ভোগে, নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, অভিভাবকদের উচিত হবে শিশুদের কথা শোনা। আর সীমা লঙ্ঘন করলে প্রয়োজনে তাকে তার সবচেয়ে পছন্দের জিনিস থেকে বঞ্চিত করা যেতে পারে।
অবশ্য বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারপারসন এমরানুল হক চৌধুরী বিবিএসের এ তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাঁর মতে, মারধরের হার আরও কম। তবে মারধর না করলে সন্তান মানুষ হবে না—এমন ধারণা থেকে এখন অনেকেই বেরিয়ে এসেছেন।
জরিপে দেখা গেছে, প্রতি পাঁচ পরিবারের তিনটিতেই শিশুদের জন্য কমপক্ষে দুই ধরনের খেলনা রয়েছে। তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতি সাতটি শিশুর একজন প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, উঠান বৈঠকে প্রজননস্বাস্থ্য থেকে শুরু করে শিশু অধিকার পর্যন্ত সব বিষয়ে আলোচনা হয়। আলাদাভাবে মারধর না করার ব্যাপারে মা-বাবাকে সচেতন করার কোনো কর্মসূচি নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজে শারীরিক নির্যাতন না করার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছে।
জরিপের ফল অনুযায়ী, ১৯ বছর হওয়ার আগেই ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। জরিপে অংশ নেওয়া ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের ৫২ দশমিক ৩ শতাংশের ১৮ বছর পার হওয়ার আগেই বিয়ে হয়েছে। আর ১৫ বছর পার হওয়ার আগে বিয়ে হয়েছে ১৮ দশমিক ১ শতাংশের।
অল্প বয়সে মেয়ে বিয়ে দেওয়া বন্ধ করতে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে বলে মনে করেন সামাজিক উন্নয়ন ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী সুলতানা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মেয়ে বড় হয়েছে—এমন চিন্তা থেকে অনেক অভিভাবক তাদের বিয়ে দেন। আবার নিজের এলাকার আশেপাশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় অনেকে পড়ালেখা বন্ধ করে বিয়ে দেন। ইভ টিজিং কিংবা নিরাপত্তার অভাবে অভিভাবকেরা অল্প বয়সে মেয়ে বিয়ে দেন বলেও তিনি মনে করেন। তাঁর মতে, এ অবস্থার উত্তরণে মেয়েদের লেখাপড়ার বিকল্প নেই।
নারীদের মধ্যে রেডিও-টেলিভিশন, সংবাদপত্র, ইন্টারনেট থেকে তথ্য জানার বিষয়টিও জরিপে উঠে এসেছে। দেখা গেছে, ৫২ শতাংশ নারী রেডিও শোনেন, টেলিভিশন দেখেন কিংবা সংবাদপত্র পড়েন। ৫০ দশমিক ১ শতাংশ শুধু টেলিভিশন থেকে তথ্য জানতে পারেন। তবে দরিদ্র পরিবারের মাত্র ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ নারী রেডিও শোনেন, টেলিভিশন দেখেন কিংবা সংবাদপত্র পড়েন। অন্যদিকে ধনী পরিবারে এ সুবিধা পান ৯১ দশমিক ৩ শতাংশ।
ফেরদৌসী সুলতানা বলেন, রেডিও-টেলিভিশনকে নারীদের তথ্য জানার মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। বিশেষ করে শিশুদের টিকা প্রদান, শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষা, বাল্যবিবাহ ঠেকানোসহ এ ধরনের বিষয়ে সচেতনতা বাড়বে।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪২ শতাংশই খর্বাকৃতির। তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি দরিদ্র পরিবারের। পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে এ ধরনের খর্বাকৃতির হার বেশি। সবচেয়ে বেশি খর্বাকৃতির হার নেত্রকোনায়, আর সবচেয়ে কম মেহেরপুরে।
অন্যদিকে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তায় দরিদ্র পরিবারের মাত্র সাড়ে ২৬ শতাংশ গর্ভবতী সন্তান জন্ম দেন।
জরিপে বলা হয়েছে, দেশের ৪ শতাংশ মানুষ এখনো খোলা আকাশের নিচে মল ত্যাগ করে। আর ৭৭ শতাংশ মানুষ উন্নত পয়োনিষ্কাশন-সুবিধা পায়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সামাজিক উন্নয়ন সূচকগুলোতে ভালো অবস্থানে যেতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করেন।
ইউনিসেফ প্রতিনিধি এডওয়ার্ড বেগবেদার বলেন, গত কয়েক বছরে শিশুদের উন্নয়নে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বৈষম্য নিরসনেও কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য দেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব কানিজ ফাতেমা ও প্রকল্প পরিচালক দীপঙ্কর রায়।