রমজানে সেহেরি ও ইফতারে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও ডাক্তারী পরামর্শ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ জুন ২০১৫, ১২:৪৬ অপরাহ্ণ
হেলথ ডেস্ক ::
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র মাস রমজান। সুস্থ ব্যক্তির রোজা রাখা ফরজ। যারা অসুস্থ তাদের অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেন রোজা রাখার। কিন্তু রোজা রাখা উচিত হবে কি না তা বুঝে উঠতে পারেন না। কেউ কেউ রোজা রাখার বিপক্ষে অজুহাত সৃষ্টি করেন এই বলে যে, রোজা রাখলে অ্যাসিডিটি বেড়ে যাবে- দেখা দেবে পেপটিক আলসার। আবার অনেকে ওষুধ খেতে অসুবিধা হবে এমন কথাও বলে থাকেন। কিন্তু যারা রোগা তারা রোজা রাখার ব্যাপারে ততটা উত্সাহী না হয়ে হাজার ব্যাখ্যা দাঁড় করান। রোজা নিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য ভাবনার শেষ নেই। রোজায় সেহরি, ইফতারি ও শারীরিক সুস্থতা নিয়ে মানুষের মনে অনেক জিজ্ঞাসা।
কেমন হবে রমজানে সেহেরি ও ইফতার
আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে রমজানে যে খাদ্যাভ্যাস পুরোপুরি স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এ সময়ে খাবারের প্রধান পর্যায় দু’টি, সেহেরি ও ইফতার। লক্ষ করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশে সেহেরি ও ইফতারের বেশির ভাগ খাবারই হচ্ছে উচ্চ চর্বিসমৃদ্ধ এবং তেলে ভাজা। সেহেরি ও ইফতারের খাবার নির্বাচনে রোজাদারের বয়স ও শারীরিক অবস্থাকে বিবেচনায় রাখা হয় না। কিন্তু এসব দিকে নজর দিতে হবে।
মূলত বছরের ১১ মাস স্বাভাবিক নিয়মে খাওয়া-দাওয়া ও ঘুম হয়। তারপর রমজান মাসে সেহেরি খাওয়ার নিয়মটি শুরু হয়। তাই এদিকে বিশেষ যত্ন না নিলে স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। স্বাভাবিকভাবে যেকোনো ধরনের খাবারই সেহেরিতে খাওয়া যায়, তবে খেয়াল রাখতে হবে- খাবারটা যেন সহজপাচ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত হয়। ভাত বাঙালির মুখ্য খাবার। তাই সেহেরিতে অবশ্যই সাদা ভাত রাখবেন। তবে ভাতের সাথে রাখতে হবে উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার যেমন- মাছ, মাংস ও ডিম। খরচ কমাতে চাইলে ভাতের সাথে শুধু ডিম ও ডাল। ডাল উদ্ভিজ প্রোটিন বলে এতে ক্ষতিকর চর্বি নেই। সেহেরির খাবার তালিকায় যেকোনো একটি সবজি থাকা বাঞ্ছনীয়। পাকস্থলীতে উত্তেজনা ও অস্বস্তি সৃষ্টি করে এমন কোনো খাবার খাওয়া উচিত নয়।
ইফতার প্রসঙ্গ
বেশির ভাগ লোককে দেখা যায়, ইফতারের সময় হুলস্থুল ধরনের খাবার-দাবার খেতে। তারা মনে করেন, সারা দিন না খাওয়ার অভাবটুকু ইফতারে পুষিয়ে নেবেন। কিন্তু এটা একটা ভুল ধারণা। ইফতার পর্বে উত্তেজক খাবার একেবারেই বর্জন করতে হবে। ইফতার শুরু করবেন শরবত দিয়ে। তবে শরবতে কৃত্রিম রঙ মেশাবেন না। এ রঙে থাকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান। বাজারে অনেক কৃত্রিম রঙ মেশানোশরবত পাওয়া যায়, সেসব অবশ্যই পরিহার করবেন। ইফতারে ফলের রস বেশ উপকারী। এসময় যেকোনো একটি ফল খাবেন, ফলে থাকে প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ, যা আপনাকে স্বাস্থ্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে। বুট, ছোলা ও মুড়ি খেতে পারেন এ সময়। দই, চিড়া ও কলা খেলে ভালো। তবে প্রচলিত বেগুনি ও পিঁয়াজু সর্বদা পরিহার করা উচিত। তেলেভাজা এসব খাবার স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটাতে পারে। তা ছাড়া খাবারগুলো পুরনো তেলে ভাজা হলে ক্ষতির পরিমাণটা বেড়ে যায়। তেল বারবার গরম করলে ক্ষতিকর পলিনিউক্লিয়ার হাইড্রোকার্বন তৈরি হয়, যার মধ্যে থাকে বেনজোপাইরিন। এটা ক্যান্সার সৃষ্টি করে। তাই ইফতারে খেঁজুর ও বিভিন্ন ফল রাখা ভালো। সারা দিন না খেয়ে থাকার ফলে শরীরে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখা দেয়। খেজুর সেই ঘাটতি পূরণে সাহায্য করে। সেহেরি এবং ইফতারির সময় প্রচুর পানি পান করবেন। পানি আপনার শরীরের কোষগুলোকে সজীব রাখবে।
পেপটিক আলসার রোগীর রোজা
পেপটিক আলসারের রোগী অবশ্যই রোজা রাখতে পারবেন। এ সময়ে খাবার-দাবারে নিয়মানুবর্তিতার সৃষ্টি হয় বলে রোজায় স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যা দেখা দেয় না। তবে সেহেরি ও ইফতারিতে তাদেরকে বাছাই করা খাবার খেতে হবে। তৈলাক্ত খাবার পরিহার করে সহজপাচ্য খাবার খেলে অ্যাসিড নিঃসরণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং স্বাস্থ্যগত কোনো অসুবিধা হবে না।
রোজা রাখলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে
রোজায় এক ধরনের শৃঙ্খলাবোধ কাজ করে। সময়মতো আহার গ্রহণ, বিশ্রাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং ধূমপান ও মদ্যপান বর্জন প্রভৃতি বিষয় প্রকারান্তরে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর সহায়ক উপাদান হিসেবে ভূমিকা রাখে।
ডায়াবেটিস রোগীর রোজা
এ ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিত্সকের পরামর্শ নিয়ে রোজা রাখতে হবে। যারা ইনসুলিন নিচ্ছেন, রোজা তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। চিকিত্সাবিজ্ঞান অনুযায়ী এদের রোজা না রাখাই ভালো। কিন্তু যারা ইনসুলিন নিচ্ছেন না, তারা রোজা রাখতে পারেন। সে ক্ষেত্রে রোজা রাখার আগে চিকিত্সকের সাথে পরামর্শ করে আপনার চিকিত্সাপত্র, খাবার ও ব্যায়ামের ব্যাপারটা ঠিক করে নেবেন। এ সময়ে দৈনন্দিন কাজ সীমিত হারে করতে হবে।
হৃদরোগীদের রোজা
হৃদরোগীদের জন্য রোজা সাধারণত অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া এ সময়ে খাদ্য নিয়ন্ত্রণে রাখার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয় বলে তাদের রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রাও ঠিক থাকে।
রোজায় পানিশূন্যতা রোধে করণীয়
সেহেরি ও ইফতারে পর্যাপ্ত পানি না পান করলে পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে। সেহেরি ও ইফতারে পর্যাপ্ত পানির সাথে শাক-সবজি ও ফলমূল খাবেন। তাহলে পানিশূন্যতার পাশাপাশি কোষ্ঠ্যকাঠিন্য থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে।
যারা ওষুধ খাচ্ছেন, রোজায় তাদের পরামর্শ
রোজার সময়ে ওষুধ কোনো সমস্যা নয়। চিকিত্সককে বলে ওষুধের মাত্রা ঠিক করে নিলেই হলো। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীকে জীবন বাঁচানোর স্বার্থে রোজা রাখার পরিকল্পনা ত্যাগ করতে হবে। অন্য ক্ষেত্রে চিকিত্সকের পরামর্শ মতো ওষুধের মাত্রা ঠিক করে নিলে রোজা রাখতে কোনো অসুবিধার সৃষ্টি হবে না।
ইফতারের সাথে সাথেই ব্যথানাশক ওষুধ নয়
রোজার সময় ইফতারের পরপরই বেশির ভাগ রোগী ভর্তি হন পেটে তীব্র ব্যথা নিয়ে। অনেকের অন্ত্র ফুটো হয়ে যায় এবং জরুরি অপারেশনের প্রয়োজন হয়। ব্যথানাশক ওষুধ খাবার কারণে পেটে তীব্র ব্যথা এবং অন্ত্র ফুটো হয়ে যাওয়া সমস্যার সৃষ্টি হয়। মূলত মাথাব্যথা করলে ইফতারের সাথে সাথেই ব্যথানাশক ওষুধ যেমন এসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম খাওয়া উচিত নয়। কিছু খেয়ে তারপর এসব ওষুধ খেতে হবে। যাদের পেপটিক আলসারের ইতিহাস আছে, তারা অ্যান্টাসিড ও রেনিটিডিন খেয়ে এসব ওষুধ খাবেন। নতুবা মাথাব্যথা সারাতে গিয়ে আপনাকে পড়তে হবে বড় সমস্যার মুখে।
রোজার সময় সারা দিন ঘুমান স্বাস্থ্যসম্মত নয়
রোজার সময় সারা দিন ঘুমালে শরীরের কোষগুলো অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। ফলে দারুণ ক্লান্তি অনুভব হয়। বরং ইফতারের পরে বিশ্রাম নেয়াই স্বাস্থ্যসম্মত। একজন সুস্থ মানুষের জন্য দৈনিক ৫-৭ ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট। এ ঘুমের জন্য আপনি ইফতার ও সেহেরির পরের সময়টুকু কাজে লাগাতে পারেন। তাছাড়া দিনের বেলা ঘুমালে রাতে নিদ্রাহীনতা দেখা দেয়, সেই সাথে জড়ো হয় স্বাস্থ্যগত আরো সমস্যা।