মানবতাবিরোধী অপরাধে মাহিদুর ও আফসারের আমৃত্যু কারাদণ্ড
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ মে ২০১৫, ৪:১৩ অপরাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটুকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আজ ১৯ মে বুধবার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলামও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
১৩৩ পৃষ্ঠার এই রায়ে বলা হয়, প্রসিকিউশনের আনা তিনটি অভিযোগের মধ্যে প্রথমটিতে দুই আসামিকে সর্বসম্মতভাবে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন তিন বিচারক।
দ্বিতীয় অভিযোগে মাহিদুর রহমান ও আফসারকে দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছরের জেল। এ সাজার আদেশ হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।
আর তৃতীয় অভিযোগে এর আগে দালাল আইনে তারা দণ্ডিত হওয়ায় ওই অভিযোগটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
তৃতীয় অভিযোগের ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।
মাহিদুর ও আফসার একাত্তরে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে তারা শিবগঞ্জ এলাকায় যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে এই রায়ে।
আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আসামিরা ব্যক্তি হিসাবে হয়তো ‘ক্ষুদ্র’, কিন্তু দলগত যুদ্ধাপরাধে তাদের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা ছিল।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, তারা আপিল করবেন।
ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত আসা ১৮টি যুদ্ধাপরাধের মামলায় ২০ আসামির মধ্যে ১৪ জনের ফাঁসির রায় এসেছে, যাদের মধ্যে দুইজনের মৃত্যুদণ্ড সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর কার্যকর করা হয়েছে।
মাহিদুর ও আফসারকে নিয়ে মোট পাঁচজনকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল, যিনি আপিল চলাকালে মারা যান।
রায়ের প্রতিক্রিয়া
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার সাংবাদিকদের বলেন, তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।
“আদালত বলেছেন, তদন্ত কর্মকর্তা অথর্ব। তার যথেষ্ট ভুলত্রুটি রয়েছে। তৃতীয় অভিযোগের বিষয়ে ইতোপূর্বে চার্জশিট হয়ে, ট্রায়াল হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ছিল।সে অভিযোগেই তদন্ত কর্মকর্তা পুনরায় তদন্ত করেছে।”
আপিলে তদন্তকারী কর্মকর্তার ‘দুর্বলতাগুলো’ তুলে ধরা হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। অন্যদিকে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় অভিযোগ বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, “ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান রেখে বলছি, আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছি, করব। মাননীয় আদালত যে রায় দিয়েছেন, তার প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল।”
তবে আফসার ও মাহিদুরের সর্বোচ্চ সাজা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শহীদ পরিবারের সদস্যরা। রায়ের পর শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুরে ফাঁসির দাবিতে মিছিলও হয়েছে।
বিনোদপুর ইউনিয়নের লছমনপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য মশিউর রহমান বাচ্চু বলেন, “এতগুলো মানুষ হত্যার অপরাধে এই দুই রাজাকারের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত ছিল।”
একই প্রতিক্রিয়া জানান মামলার সাক্ষী আব্দুর রহিম বক্স মণ্ডলের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা মহসিন আলী ও শহীদ পরিবারের সদস্য সফিকুল ইসলাম।
অন্যদিকে দণ্ডিত আফসার হোসেন চুটুর ছোট ছেলে মাসুদ বলেন, একই অপরাধে আমার বাবা জেল খেটেছিলেন। আমরা আশা করেছিলাম, এবার তাকে খালাস দেওয়া হবে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানান মাসুদ।
‘ক্ষুদ্র ব্যক্তির বৃহৎ অপরাধ’
আফসার ও মাহিদুরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সকালে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসার পর ১০টা ৪৫ মিনিটে আদালতকক্ষে নিয়ে আসা হয়।
এ সময় মাহিদুরের পরনে ছিল একটি ঘিয়ে রংয়ের পাঞ্জাবি ও সাদা পাজামা, চোখে চশমা। আফসারের পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি।
রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন মাহিদুরের স্ত্রী আকতারা বেগম, ছেলে মামুনুর রশীদ, তার নাতি ও নাতনি। তবে আফসারের পরিবারের কাউকে আদালতে দেখা যায়নি।
বিচারক যখন রায় পড়ছিলেন, মাহিদুরকে তখন দুই হাত একসঙ্গে করে মনোযোগ দিয়ে শুনতে দেখা যায়। আর আফসার রায় শুনছিলেন হাঁটুর উপর হাত রেখে।
রায়ের একাংশে বলা হয়, “স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর সদস্য হয়ে মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটু জেনেশুনে স্বতঃস্ফূর্ত ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপরাধী দলের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড একটি ‘দলীয় পরিকল্পনা’র অংশ হিসেবে ঘটানো হয়েছিল।
আসামি মাহিদুর ও আফসার ব্যক্তি হিসাবে ‘ক্ষুদ্র’ হলেও সেই দলগত পরিকল্পনায় তাদের ভূমিকা ছিল ‘গুরুত্বপূর্ণ’। তাদের ব্যক্তিগত পরিকল্পনা দলগত পরিকল্পনার ভেতরে ‘যথার্থভাবে স্থাপিত’ হয়েছিল।
“স্থানীয় রাজাকারদের পরিকল্পনায় সক্রিয় অংশ ছিল অভিযুক্তরা। এতে প্রমাণিত হয় অভিযুক্তরা ১৯৭১ সালে স্থানীয়ভাবে কুখ্যাত রাজাকার ছিল এবং স্বাধীনতার পক্ষের সাধারণ লোকদের প্রতি নৃশংস ও প্রতিহিংসামূলক মনোভাব নিয়ে বর্বর ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়েছিল।”
রায়ের পর দুপুরে একটি প্রিজন ভ্যানে করে দুই আসামিকে ট্রাইব্যুনাল থেকে কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। তাদের প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় মাহিদুরের হাতে দেখা যায় কয়েকটি কলা। আর আফসারের হাতে ছিল পলিব্যাগে মোড়ানো বনরুটি।
একাত্তরের রাজাকার মাহিদুর–আফসার
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর ইউনিয়নের দাদনচক গ্রামের সুবেদার আলী বিশ্বাসের ছেলে মো. মাহিদুর রহমানের বয়স বর্তমানে ৮৪ বছর। ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, মাহিদুর লেখাপড়া করেছেন নবম শ্রেণি পর্যন্ত।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক ছেলে ও চার মেয়ের বাবা মাহিদুর একাত্তরে ছিলেন কৃষিজীবী। স্থানীয় মুসলিম লীগের রাজনীতিতেও তিনি সক্রিয় ছিলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর মাহিদুর সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন।
অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি স্থানীয় রাজাকার ক্যাম্পেই থাকতেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় আশপাশের এলাকায় হত্যা, লুটপাট, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন।
প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, আফসার হোসেন ওরফে চুটুর বয়স বর্তমানে ৬৫ বছর। তিনি শিবগঞ্জের বিনোদপুর ইউনিয়নের সাতরশিয়া গ্রামের কুতুব উদ্দিন মণ্ডলের ছেলে।
পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা আফসার দুই ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা। মাহিদুরের মতো একাত্তরে তিনিও ছিলেন কৃষিজীবী এবং মুসলিম লীগের কর্মী।
আফসারও মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং ওই এলাকায় বিভিন্ন মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালান।
একাত্তরের ২ নভেম্বর আফসার ও মাহিদুরের নেতৃত্বে শিবগঞ্জ থানাধীন শেরপুর ভাণ্ডার, আদিনা ফজলুল হক সরকারি কলেজ, শিবগঞ্জ সিও (ডেভ) অফিস আর্মি ক্যাম্প এবং উপজেলা সংলগ্ন ইয়াকুব বিশ্বাসের আমবাগান এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে কলিমুদ্দিন মণ্ডলসহ চারজনকে হত্যা করে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে কলিমুদ্দিনের ছেলে মো. লায়েসউদ্দিন দালাল আইনে একটি মামলা করেন। এক নম্বর সাক্ষী হিসেবে তিনি আদালতে সাক্ষ্যও দেন।
রাজশাহীর দুই নম্বর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সে সময় ওই মামলায় মাহিদুর ও আফসারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। পরে আপিলেও তাদের সাজা বহাল থাকে এবং দুই আসামিকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সাজাও খাটতে হয়।
মামলার পূর্বাপর
মুক্তিযুদ্ধের সময় শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর স্কুল মাঠ ও আশেপাশের এলাকায় গণহত্যার ঘটনায় ২০১৩ সালে মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটুসহ ১২ জনকে আসামি করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালতে একটি মামলা হয়।
মামলাটি করেন গণহত্যার শিকার শহীদ পরিবারের সদস্য শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের পারচৌকা গ্রামের বদিউর রহমান বুদ্ধু। পরে তা ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
প্রসিকিউশনের তদন্ত দল এ দুই রাজাকার সদস্যের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে গত বছর ১১ ফেব্রুয়ারি। তদন্ত শেষে ৭ খণ্ডে ৯৫৬ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর শিবগঞ্জের দুর্লভপুর ইউনিয়ন থেকে মাহিদুর এবং বিনোদপুর থেকে আফসারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ওইবছর ১৬ নভেম্বর মাহিদুর ও আফসারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান। ২৪ নভেম্বর তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নেয়।
অভিযোগ গঠনের পর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গতবছর ১২ জানুয়ারি শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেডএম আলতাফুর রহমানসহ প্রসিকিউশনের মোট ১০ জন সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে দুই আসামির পক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষী ছিলেন না।
সাক্ষ্য-জেরা শেষে দুই পক্ষের আইনজীবীরা আদালতের সামনে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে।
যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল গত ২২ এপ্রিল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখে।