দালালদের প্রলোভনে অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যাত্রা
সুনামগঞ্জের ১৩ যুবক নিখোঁজ, উদ্বিগ্ন স্বজনরা
প্রকাশিত হয়েছে : ৭ মে ২০১৫, ৮:৫৮ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
ভাগ্য বদলের আশায় দালালদের প্রলোভনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছে বহু বাংলাদেশিরা। এভাবেই গত তিন মাসে সুনামগঞ্জের অন্তত ২০০ যুবক পাড়ি জমিয়েছেন। এর মধ্যে চারজন নির্যাতনে মারা গেছেন আর ১৩ জনের কোনো খোঁজ পাচ্ছে না তাঁদের স্বজনরা। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবরে বাংলাদেশির লাশ পাওয়া যাওয়ার খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমানো শ্রমিকদের স্বজনরা।
গত তিন মাসে সুনামগঞ্জ থেকে অন্তত ২০০ যুবক স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তাঁদের চারজন মারা গেছেন। গত মার্চ মাসে পাড়ি জমানো ১৩ জনের কোনো খোঁজ পাচ্ছে না স্বজনরা।
শ্রমিকদের স্বজনরা জানায়, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ডুংরিয়া গ্রামের আব্দুল গণি ভাণ্ডারী, নুরপুর গ্রামের ইয়াহিয়া ও নূরুল ইসলাম, কেশবপুর গ্রামের ইমান আলী, জয়কলস ইউনিয়নের কামরূপদলং গ্রামের আফতেরা বেগম, নূরপুর গ্রামের হেলাউর রহমান, জাহানপুর গ্রামের সৈয়দুর রহমানসহ একটি দালালচক্র প্রলোভন দেখিয়ে জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে শ্রমিকদের অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে আসছে। এই চক্র বিনা টাকায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার টোপ দিয়ে বেকার যুবক বা শ্রমিকদের চট্টগ্রামের দালালদের যোগসাজশে সাগরপথে পাচার করছে। জাহাজে তোলার পরই শ্রমিকদের জিম্মি করে নির্যাতন চালিয়ে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে খবর দেওয়া হয়, জীবন বাঁচাতে চাইলে দ্রুত টাকা পাঠাতে হবে।
জানা যায়, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ডুংরিয়া গ্রামের দালাল আবদুল গণি ভাণ্ডারীর পাঠানো চার শ্রমিক শিমুলবাক ইউনিয়নের তেরহাল গ্রামের সিরাজ মিয়া, জয়কলস ইউনিয়নের ডুংরিয়া গ্রামের এরশাদ আলীর ছেলে সাইফুল ইসলাম, শিবপুর গ্রামের মৃত আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে শাহিনুর আলম এবং শান্তিগঞ্জ বাজার এলাকার বাসিন্দা মুজিবুর রহমান ইতিমধ্যে মারা গেছেন। মুজিবুর মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে তাঁর স্ত্রী পারভীন বেগমকে ফোন করে বলা হয়, মুজিবুরকে বাঁচাতে চাইলে মুক্তিপণ দিতে হবে। তখন তাঁর পরিবার এলাকাবাসীকে নিয়ে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা দালাল আবদুল গণি ভাণ্ডারীর হাতে তুলে দেয়। কিন্তু সেই টাকা মালয়েশিয়ায় দালালদের কাছে না পাঠানোয় পিটিয়ে হত্যা করা হয় মুজিবুরকে। পরে এলাকাবাসীর চাপে গণি ভাণ্ডারী টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হলেও কয়েকজন প্রভাবশালীর ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় গণি ভাণ্ডারীর বিরুদ্ধে ভয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারছে না স্বজনরা।
নিখোঁজদের স্বজনরা জানায়, গত মার্চ মাসে স্থানীয় দালালরা অন্তত ২০ জনকে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর পর তাঁদের মধ্যে প্রায় ১৩ জনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁরা হলেন জামালগঞ্জ উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের মো. আব্বাছ আলী, ফয়জুন নুর, এনামুল হক, আইনুল হক, জুয়েল মিয়া; একই উপজেলার চেলাইয়া গ্রামের সুমন মিয়া, রুহুল আমীন; দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নূরপুরের জুবেদ আহমদ, আলকাছ আলী, আব্দুল কদ্দুছ, মঈন মিয়া, রইছ মিয়া এবং সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার বানীপুর গ্রামের ওমর আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেন।
বানীপুর গ্রামের ওমর আলী বলেন, আমার ছেলে আনোয়ার সিএনজি চালাত। তাকে প্রলোভন দেখিয়ে ইয়াহিয়া ও নূরুল ইসলামসহ একটি দালালচক্র সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে। জাহাজে ওঠার পর আমরা তার খবর পেয়েছিলাম। প্রায় এক মাসের মতো সময় হয় তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না।
জামালগঞ্জ উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের আব্বাছের বড় ভাই ইউনুছ মিয়া বলেন, আমার ছোট ভাই আব্বাসকে দালাল নূরুল ইসলাম মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে। সেখানে পৌঁছার পর আমার ভাইকে নির্যাতন করার খবর পেলে আমরা বাড়ি বিক্রি করে নূরুল ইসলামের হাতে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছি। এর পরও আমার ভাইয়ের খোঁজ পাচ্ছি না।
নিহত মুজিবুরের স্ত্রী পারভীন বেগম বলেন, আমাদের না জানিয়ে আবদুল গণি আমার স্বামীকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে মেরে ফেলেছে। মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে গণির কাছে টাকা দেওয়ার কথা বললে আমরা এলাকার মেম্বারের সামনে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু দুই দিন পরেই স্বামীর মৃত্যুর খবর পাই। আমরা মামলা করতে চাইলে গণি আমার স্বামীর স্বজনদের লোভ ও ভয় দেখিয়ে মামলা থেকে বিরত রেখেছে। এখন আমি আল্লাহর কাছে বিচার চাই।
নূরপুর গ্রামের অভিযুক্ত ইয়াহিয়া ও নূরুল ইসলাম বলেন, আমরা বৈধভাবে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে লোক পাঠিয়ে থাকি।’ আবদুল গণি ভাণ্ডারী মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর কথা স্বীকার করলেও তিনি যাঁরা যেতে চান তাঁদের সহযোগিতা করেন বলে জানান।
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. হারুন অর রশিদ বলেন, আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো দালালের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি। নিখোঁজের বিষয়েও আমরা কিছু জানি না। আমাদের কাছে কোনো নিখোঁজ শ্রমিকের কেউ অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব।