জীবন যুদ্ধ
‘পানি বিক্রি করে খাই তবু কারো কাছে হাত পাতি না’
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ মার্চ ২০১৫, ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ
মহ্সীন মুরাদ ::
‘ইট ভেঙেছি ১০ বছর। ৭ বছর যাবত ভ্যান গাড়ি টেনে দোকানে দোকানে পানি বিক্রি করে খাই তবু কারো কাছে হাত পাতি না। স্বামীর মৃত্যুর পর আজ পর্যন্ত দুপা এক করে ঘুমোতে পারিনি। এমনকি ঈদের দিনেও আমাকে কাজ করতে হয়েছে। যতদিন শরীরে শক্তি আছে আল্লাহ যেন কারো দুয়ারে না নেন এমনটাই কামনা করি।’
মৌলভীবাজার শহরে পশ্চিমবাজার এলাকায় বাস করেন চল্লিশোর্ধ্ব আনোয়ারা বেগম। কিশোর বয়স থেকেই তিনি এ এলাকায় থাকেন। ’৮৪ সালের বন্যার সময় তার প্রথম বাচ্চা হয়। সে হিসাব আঙ্গুলে গুণেগুণে তিনি বলেন এর দুবছর আগে বিয়ে হয়েছে স্থানীয় শিক্ষিত এক সরকারি চাকুরিজীবীর সাথে।
স্বামীর নাম মো. ছাইম উদ্দিন মাস্টার। তিনি শ্রীমঙ্গলের কালাপুর ইউনিয়নের তখনকার সচিব ছিলেন। তার বাড়ি ভৈরববাজার এলাকায়। পাশাপাশি মৌলভীবাজার শহরের চা পাতার ব্যবসা করতেন। আনোয়ারার সাথে সংসার করে তিন সন্তান জন্ম দেয়ার পর হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কোলের মেয়েসহ কেবল হাঁটতে শিখা দুই ছেলে সন্তানকে নিয়ে আনোয়ারার সংগ্রামী জীবনের সূচনা।
আনোয়ারা বলেন, সমাজের মানুষ বিভিন্ন রকমের কথা বলে। তাই বাধ্য হয়ে সামাজিক আশ্রয়ের জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করি আমি। বর্তমানে তিন সন্তানকে নিয়ে দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে আনোয়ারা। বিয়েটা শুধুই আশ্রয়। নিজেই খেটে-খুটে পরিবার চালাতে হয়। স্বামী আব্দুর রহিম পরিবার চালনার কোন ভার বহন না করায় একাই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে আনোয়ারাকে।
আনোয়ারা জানান, আমাদের যেখানে বাসা ছিল সে জায়গাটা পাকিস্তানী আমল থেকে আমার স্বামীর বসবাসসূত্রে দখলী মালিকানায় ছিল। এই বাসার সামনে প্রথমে চায়ের দোকান দেই। এর আয় দ্বারাই চলতে থাকে পরিবার। কিন্তু কয়েক বছর পর বড় ছেলে পড়া বাদ দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যায় আর ছোট ছেলে ক্লাস টেনে পড়ার সময় প্রাইভেট ম্যাডামের সাথে প্রেম করে পালিয়ে যায়। মেয়েটা থেকে যায় আমার কাছেই। আমার বড় বোনের সহযোগিতায় পরিণত বয়স হলে তাকে বিয়ে দেই। এদিকে দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে দুই মেয়ের জন্ম হয়। বর্তমানে একজন আলী আমজদ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে এবং অন্যজন বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
আনোয়ারা এ প্রতিবেদককে জানান, ১৮ বছর বয়সে প্রথম স্বামী মারা যান। তার আকস্মিক মৃত্যুতে দখলকৃত জায়গাটাতে বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। এতে করে প্রায় কোটি টাকার সম্পদ বেহাত হয়। বড় ছেলে নেশাগ্রস্ত হয়ে একদিন তার সাথে দুর্ব্যবহার করে। পরে আমি বাধ্য হয়ে কোর্টে গিয়ে দস্তখত করে বাসার জায়গা ছেড়ে দেই। যদিও এ জায়গা টিকিয়ে রাখার জন্য পরবর্তীতে হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত গিয়েছি। অনেক টাকা-পয়সাও খরচ করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর টিকিয়ে রাখতে পারিনি। নিজের জন্য কোন চিন্তা করি না। আমি হোটেলের কাজ জানি, বাসায়ও কাজ করতে পারবো। কিন্তু দুইটা মেয়ে থাকার কারণে আটকে গেছি। আনোয়ারা পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের নাগরিক হলেও বর্তমানে থাকেন সেন্ট্রাল রোডের কয়সর মিয়ার বাসায়।
মাঝ ফেব্রুয়ারির এক সকালে মৌলভীবাজার শহরের বেরিরপাড় এলাকায় ফুটপাতে বসে চা খাওয়ার এ ফাঁকে আনোয়ারা বেগমকে দেখা। পানির ভ্যান টেনে টেনে আসছেন এক মহিলা। সাথে সাথে ক্যামেরাটা বের করে ছবি তুলে নিলাম। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম তিনি দোকানে দোকানে পানি দিয়ে যাচ্ছেন।
পরবর্তীতে একদিন সরাসরি কথা হয় আনোয়ারার সাথে। তিনি জানান, তার বাবার বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার বিশকারআলী গ্রামে। প্রতিদিন ৩০ টাকা ভ্যান ভাড়া। আর পানি যে বাসা থেকে সংগ্রহ করি তাকে দেই ১০০ টাকা। প্রতি দোকানে ৫ থেকে ১০ লিটার পানি দিলে ২০ থেকে ৩০ টাকা পাই। এলাকার সবার সাথে ভাল পরিচয়। তাই টাকা দেয়া নেয়ায় তিনি ধরকষাকষি করেন না। সবাই তাকে পছন্দ করে। আনোয়ারার জীবিকা রক্ষার তাকিদে পানি বিক্রি করে সংসার পরিচালনা একটি সাহসী জীবনের প্রতিচ্ছবি। আপনার এ অবস্থা দেখে কেউ সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেনি এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আল্লাহ ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আর কারো দুয়ারে যাইনি বলে কেউ সাহায্য করেনি। আর আমিও চাই যতদিন হাত পা চলবে, ততদিন কারো করুণাপ্রার্থী না হতে।