বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪, ৭:৫০ পূর্বাহ্ণ
অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক ::
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার এক বছরের ব্যবধানে ২০০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১১ সালে দেশ থেকে পাচার হয়েছিল ৫৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৪ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৮ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) ‘ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিজ: ২০০৩-১২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ডেভ কার ও অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্পেনজারসের তৈরি প্রতিবেদনটি গত সোমবার মধ্যরাতে প্রকাশ করা হয়। এতে বিশ্বের উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে এক দশকে কী পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে বাইরে চলে গেছে, তার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতি বছরের ডিসেম্বরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১৩১ কোটি ৬০ লাখ ডলার অবৈধ পথে বাংলাদেশের বাইরে চলে গেছে। এ ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে ২০০৬ সালে, ২৬৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়। সে সময় অবৈধ উপায়ে দেশের বাইরে চলে যায় ২৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অর্থ পাচার কমে আসে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে ২০১২ সালে তা আবার বেড়ে যায়। অস্বচ্ছ ব্যবসায়িক লেনদেন, দুর্নীতি ও কর ফাঁকির মাধ্যমে এ অর্থ স্থানান্তর করা হয়।
অর্থ পাচারের যেসব পন্থা রয়েছে, তারই একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মিস ইনভয়েসিং বা অস্বচ্ছ লেনদেন। জিএফআই বলছে, ২০১২ সালে মিস ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আর হট মানি আউটফ্লো বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টের মাধ্যমে পাচার হয়েছে ১০২ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণের ক্রমানুসারে ১৫১টি উন্নয়নশীল দেশের একটি তালিকাও তৈরি করেছে জিএফআই। ২০১২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান তাতে ৪৭তম। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে।
অর্থ পাচারের বিভিন্ন ধরন
দেশের একটি বিদ্যুৎ উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরে কার্যালয় স্থাপন করেছে। দেশের বিদ্যুকেন্দ্র চালু রাখার জন্য সে কার্যালয়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত মূল্যে তেল আমদানিও করেছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের অক্টোবরে প্রতি টন তেল ৬৫৯ দশমিক ২৪ ডলারে কেনে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও তখন সিঙ্গাপুরে তেলের দাম ছিল ৬১৪ দশমিক ২৭ ডলার। জাহাজ ভাড়াসহ প্রতিষ্ঠানটির প্রতি টনে ব্যয় হয় ৬৭৬ দশমিক ৭৪ ডলার। অথচ একই সময়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রতি টন ফার্নেস অয়েল জাহাজ ভাড়াসহ আমদানি করে ৬৪৮ দশমিক ৩৪ ডলারে। এছাড়া ডিসেম্বরে জাহাজ ভাড়াসহ ওই প্রতিষ্ঠান তেল আনে ৬৬৮ দশমিক ৯৫ ডলারে। একই সময়ে বিপিসি আনে ৬৫৩ দশমিক ৭১ ডলারে।
গত বছর ভারত পেঁয়াজের রফতানি মূল্য কমানোর পরও অনেক ব্যবসায়ী আগের মূল্য দেখিয়ে পণ্যটি আমদানি করেন। এর মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয় বলে সে সময় অভিযোগ ওঠে। তুলা আমদানির নামেও অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
জিএফআই বলছে, ২০০৩ থেকে ২০১২ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে অন্তত ৬ লাখ ৫৮ হাজার কোটি ডলার অবৈধ পথে বেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে ২০১২ সালেই বেরিয়ে গেছে ৯৯ হাজার ১২৪ কোটি ডলার। ২০০৩-১২ সময়ে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে চীন থেকে, যার পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার ২৪১ কোটি ডলারের বেশি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাশিয়া। ২০১২ সালে দেশটি থেকে পাচার হয়েছে ৯৭ হাজার ৩৮৫ কোটি ডলারের বেশি। শীর্ষ পাঁচে এর পর রয়েছে যথাক্রমে মেক্সিকো, ভারত ও মালয়েশিয়া। পাচার হয়ে যাওয়া এসব অর্থ জমা হয়েছে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এবং ট্যাক্স হেভেন বলে পরিচিত বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে।
এদিকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সঙ্গে জিএফআই যৌথভাবে প্রণয়ন করে ‘ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ফ্রম দ্য লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রিজ: ১৯৯০-২০০৮’। ২০১১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে এলডিসিভুক্ত ৪৮টি দেশ থেকে অর্থ পাচারের প্রবণতা তুলে ধরা হয়।
এতে বলা হয়, ১৯ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩ হাজার ৪১৯ কোটি ২৬ লাখ ডলার পাচার হয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৯৯০ সালে পাচার হয় ১১১ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। মূলত এরশাদ সরকারের পতনের সময়ে এ অর্থ পাচার হয়। গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫— এ পাঁচ বছরে অর্থ পাচারের প্রবণতা সবচেয়ে কম ছিল। ওই পাঁচ বছরে ২০১ কোটি ৫৭ লাখ ডলার পাচার হয়। এর মধ্যে ১৯৯২ সালে কোনো অর্থই পাচার হয়নি। এর পর অর্থ পাচারের পরিমাণ অনেকটা বেড়ে যায়। ১৯৯৬-২০০০ সালে অর্থ পাচারের পরিমাণ ছিল ৬৫৪ কোটি ৯৭ লাখ ডলার, ২০০১-০৬ সালে ১ হাজার ২১৬ কোটি ও ২০০৬-০৮ সালে ১ হাজার ২৩৪ কোটি ৭৪ লাখ ডলার।
গত জুনে ইউএনডিপি প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতার পর চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির আকারের প্রায় ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। সে হিসাবে গত চার দশকে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। এ অর্থ পাচারের মূল পন্থা আমদানি-রফতানিতে পণ্যের মূল্য কম-বেশি দেখানো (মিস ইনভয়েসিং)। আমদানি-রফতানিতে পণ্যের মূল্য বেশি ও কম দেখানোর মাধ্যমে পাচার করা অর্থের পরিমাণ ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ। বাকিটা বিভিন্ন দেশের এজেন্টের মাধ্যমে হুন্ডি করে পাচার হয়।