আয়-বৈষম্য বৃদ্ধির ভয়ঙ্কর চক্রে বাংলাদেশর অর্থনীতি
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ নভেম্বর ২০১৪, ৯:২৯ পূর্বাহ্ণ
ইকোনমি ডেস্ক ::
অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেত্স প্রবৃদ্ধি ও আয় বণ্টনের অসাম্য নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব আছে অর্থনীতিভাষ্যে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে “উল্টানো ইউ” অনুমান। বিষয়টি এ রকম, অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে সমাজের সব ব্যক্তি-গোষ্ঠী সমানভাবে লাভবান হন না। প্রথম পর্যায়ে ধনী ব্যক্তিরাই বেশি লাভবান হন, যার ফলে অসাম্য বৃদ্ধি পায়। তবে ধীরে ধীরে একটা পর্যায়ে এ পার্থক্য কমতে থাকে এবং আয়-বৈষম্য হ্রাস পায়।
কুজনেৎসের প্রতিপাদ্য নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে। ফলাফল মিশ্র। কিছু দেশ যেমন— দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান উচ্চ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি আয় বণ্টনের পার্থক্য কম রাখতে পেরেছে। অন্যদিকে— ভারত, চীন, বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি আয়-বৈষম্য ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলেছে এবং জনগোষ্ঠীর বিরাট একটা অংশ নিম্ন আয়ের ফাঁদে স্থায়ীভাবে আটকা পড়েছে। তাদের আয় এতই কম যে, জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন সংস্থানেই টানাপড়েন। খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান সংগ্রহ তাদের জন্য কষ্টকর। এসব পরিবারে শিক্ষার প্রসার কম, পুষ্টি ও চিকিৎসার অভাবে এদের অনেকেই নানা রোগে ভোগেন।
উন্নয়নের একটা পর্যায়ের সম্পদ বণ্টনে অসাম্য হ্রাস করা না গেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য তা ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, শুধু প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের স্বাদ এনে দিতে পারে না। উন্নয়নের অর্থ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা। খাদ্যের নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ পানি, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বেছে নেয়ার স্বাধীনতা এর অন্যতম উপকরণ।
বাংলাদেশে গত দুই দশকে গড়ে ৫ শতাংশের বেশি হারে প্রবৃদ্ধি হলেও দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষের আয় এখনো দৈনিক আড়াই ডলারের কম, যা উন্নয়নের প্রহেলিকাসম। ফলে রাস্তায় বিলাসবহুল গাড়ি, শহরে নতুন মাল্টিপ্লেক্স বা উচ্চ অট্টালিকা এসব দৃশ্যের বিস্তার ঘটলেও সিংহভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের ফাঁদে আটকা পড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যও বলছে, এখনো নিম্ন আয়ের মধ্যে আটকে আছে দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ বা ১২ কোটি ৭৫ লাখ মানুষ। এদের দৈনিক ক্রয়ক্ষমতা ২ দশমিক ৫০ ডলার বা ২০০ টাকার নিচে।
অর্থনীতির মূল সুফলভোগী উচ্চবিত্তরাই— এমন মন্তব্য করে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, উচ্চবিত্তরা দ্রুতগতিতে সম্পদ বাড়াচ্ছে এটা সঠিক। ফলে আয়-বৈষম্য বেড়েই চলেছে। কোনো রকমে খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার মতো অবস্থা দরিদ্র মানুষগুলোর। বর্তমান অবস্থার ছন্দপতন হলেই বড় ধরনের বিপদের মধ্যে পড়বে তারা।
চলতি (২০১৪-১৫) অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগে দেশের উচ্চবিত্তদের একটি হিসাব করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সেখানেও দেখা যায়, দেশের মোট সম্পদের বেশির ভাগের মালিক মাত্র দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ মানুষ। তাদের বার্ষিক আয় ৪৪ লাখ ২০ হাজার টাকার উপর। এসব ব্যক্তির সম্পদ আছে কোটি টাকার বেশি। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার অতি ধনী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরাই দেশের অর্থনীতির মূল সুবিধাভোগী। অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরু করে সব সুবিধা কাজে লাগিয়ে সম্পদ সৃষ্টি করছে উচ্চবিত্ত শ্রেণীটি। কারণ সরকারের সুবিধা ভোগ করার মতো সব ধরনের ক্ষমতা তাদেরই রয়েছে। এটাই তাদের সম্পদ বহুগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, এক দশকে জিডিপির আকার বেড়ে হয়েছে চার গুণ। ২০০৫-০৬ অর্থবছর জিডিপির আকার ছিল ৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী তা বেড়ে হয়েছে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছর দেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৯ লাখ ১৫ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। এ সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশের ওপর।
যদিও সরকারের দাবি, দেশে দারিদ্র্য ব্যাপক হারে কমছে। ১৯৯১ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত দেশের ৫৬ দশমিক ৭০ শতাংশ মানুষ। সর্বশেষ হিসাবে ২০১০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারের নানা পদক্ষেপে দারিদ্র্য কমে গেছে। আসন্ন সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে। এতে দারিদ্র্যের হার হ্রাসের ধারা ধরে রাখা যাবে।