পাখি শিকার নিয়ে ৭ বছর মামলা, গ্রাম আদালতে নিষ্পত্তি
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ নভেম্বর ২০১৪, ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ
মহ্সীন মুরাদ :: একমাত্র পাখি শিকারই ছিল বিবাদের বিষয়। ৭ বছর যাবত চলছিল সে মামলা। আদালতের বারান্দায় কত বার না ঘোরপাক খেয়েছেন বাদি-বিবাদি। জমি-জমা বিক্রি করে কত টাকা পয়সা যে দিয়েছেন দালালদের হাতে, তার কোন হিসেব নেই। এ নিয়ে দুই ইউনিয়নেই ছিল ‘যেখানে পাও সেখানেই মারও’ এরকম অবস্থা। অবশেষে গ্রাম আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের মাধ্যমে এ মামলার নিষ্পত্তি করেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শেখ রুমেল আহমদ।
তিনি বলেন, আমতৈল ইউনিয়নের এক লোক ও আমাদের ইউনিয়নের মুটুকপুর এলাকার মো. কয়ছর আলীর মধ্যে দীর্ঘ ৭ বছর যাবত উচ্চ আদালতে মামলা চলে আসছিল। আদালতের বারান্দায় অনেকদিন হাটা-হাটির পরেও এর কোন সুরাহা হয়নি। পরে ইউপি চেয়ারম্যান তার নিজস্ব উদ্যোগে গ্রাম আদালতের বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে ৫০০০ টাকা জরিমানা করে এর মামলা নিষ্পত্তি করেন। গ্রাম আদলতের মাধমে লোকজন সুফল ভোগ করছে এমন নিশ্চয়তা দিয়ে তিনি বলেন, আমার এলাকায় গত ৭ থেকে ৮ বছরে আনুমানিক ৮১টিরও অধিক মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। তারমাঝে ৫১টি মামলার নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে। হাতের নাগালে এরকম সুযোগ সুবিধা থাকার কারণে জনসাধারণের টাকা খরচ করে উচ্চ আদালতে যেতে হচ্ছে না। এক কথা বলা যায়, কোন খরচ ছাড়াই ঘটমান ছোট-খাটো বিষয়গুলোর মীমাংসা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, ‘পাখি বিষয়ক মামলা’র যে অবস্থা ছিল ‘যেখানে পাও সেখানে মারো’ এরকম অবস্থা কাটিয়ে বাদি-বিবাদির মাঝে এখন সু সম্পর্ক বইছে। তাই আমি মনে করি গ্রাম আদালত একটি গুরত্বপূর্ণ আদালত। দেশের বঞ্চিত জনগণ গ্রাম আদালতের বিচারিক কার্যক্রমে ন্যায়বিচার পাচ্ছে এবং আগমীতে পাবে।
জানা যায়, ১৯৭৬ সালে পল্লী এলাকায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গ্রাম আদালত গঠন করা হয়। এ আদালতে ৩ ধরনের মামলা নেয়া হয়। দেওয়ানী, ফৌজদারি ও পারিবারিক দাঙ্গা সংক্রান্ত মামলা। দেওয়ানী মামলার জন্য ৪, ফৌজদারীর জন্য ২, আর পারিবারি মামলা দায়েরের জন্য ২০ টাকা ফী নেয়া হয়। কম খরচ, কম সময়ে ছোট খাটো যেকোন মামলার বিচারকার্য নিস্পষ্পিত্তিতে এলাকাবাসী সন্তোষ প্রকাশ করছেন। পাশাপাশি লক্ষ্য করা যায়, প্রাচিনকালের দাঙ্গা-হাঙ্গামা অনেকটা ভুলে সম্প্রীতি বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে জরসাধারণ। এতে সাধারণ অর্থনৈতিক, পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে উন্নতি হচ্ছে বলে জানান কয়েকজন ইউপি চেয়্যারম্যান।
গ্রাম আদালত গঠনসূত্রে জানা যায়, গ্রাম আদালত আইন ১৯৭৬ সালে পাশ হয়। সংশোধনীর মাধ্যমে ২০০৬ সালে পাশ করা হয়। পরবর্তিতে জাতীয় সংসদে গ্রাম আদালত (সংশোধন) আইন ২০১৩ পাশ হলে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সংশোধিত আইনের যথাযথ অনুসরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ নির্দেশনাসহ গেজেট কপি সকল ইউনিয়ন পরিষদে পৌঁছানো হয়। নির্দেশনাপত্রে গ্রাম আদালত (সংশোধন) আইন ২০১৩ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, গ্রাম আদালতের এখতিয়ার ২৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ৭৫ হাজার টাকায় বৃদ্ধি করে গ্রাম আদালতে বিচার ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত ও সহজ করতেই গঠন করা হয়েছে এ আদালত।
বিভিন্ন ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, গ্রাম আদালতের এ সেবাপাওয়ার জন্য প্রথমে সাদা কাগজে ইউপি চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ করতে হয়। চেয়ারম্যান অভিযোগ অমূলক মনে করলে নাকচ করতে পারেন। তবে নাকচের কারণ উল্লেখ করে আবেদনপত্র আবেদনকারীকে ফেরত দিতে হবে। ১ জন চেয়ারম্যান এবং বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের মনোনীত দুজন মিলিয়ে মোট ৫ জন সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালত গঠিত হয়। প্রত্যেক পক্ষ কর্তৃক মনোনীত ২জন সদস্যের একজন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হবেন। ইউপি চেয়ারম্যানই গ্রাম আদালতের রায় দিবেন। যদি চেয়ারম্যান কারণবশত দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন বা তার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে আপত্তি ওঠে তাহলে পরিষদের অন্য কোন সদস্য আদালতের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন।
এদিকে সদর উপজেলার কাগাবলা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ বলেন, গ্রাম আদালত শুরুর প্রথমদিকে আমাদের এ ইউনিয়নে অনেক মামলা হয়েছে। বর্তমানে অনেকটা কম। ২০১২ সালে ৩৮টি মামলা হয়েছে। ২০১৩ সালের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৩টি মামলাসহ মোট ৪১টি মামলার নিস্পত্তি করা হয়েছে। যদিও মামলা কমেছে তবে খাতায় এন্ট্রি ছাড়াও যে কোন ধরনের সমস্যা হলে আমরা সালিশীর মাধ্যমে তার সমাপ্তি করি। এরকম বিচার মাসে অন্তত ৮ থেকে ১০টি করতে হয়।
গ্রাম আদালতকে আরো শক্তিশালী করতে হলে আর কী প্রয়োজন বলে মনে করেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, গ্রাম আদালতকে আরো শক্তিশালী করতে হলে আগে যা প্রয়োজন তা হল আমরা শুধু বিচারে দোষীকে জরিমানা করতে পারি কিন্তু জেল হাজত দিতে পারি না। সে ক্ষেত্রে গ্রাম আদালতের আরো ক্ষমতা বৃদ্ধি করলে জনগণ আরো উপকৃত হবে। গ্রাম আদালতের মাধ্যমে সন্তেুাষ্ট রয়েছেন এমন অনেক নজির রয়েছে আমাদের ইউনিয়নে। তার মাঝে আমরা ভেঙে যাওয়া অনেক পরিবারকে জোড়া দিয়ে সেখানে শান্তি এনে দিতে পেরেছি।
নওমৌজা কমিটির সেক্রেটারি বুরুতলা এলাকার মুরব্বি ইমন মোস্তফা জানান, আমাদের এলাকার অনেকগুলো সমস্যা ঘটে থাকে। সেগুলোর মধ্যে যদি ১০০টি সমস্যা হয় তার মাঝে ৮০টির সমাধানই আমরা ইউনিয়ন পর্যন্ত না গড়িয়ে নিজ এলাকায়ই তার সমাধান করে থাকি। মাঝে মাঝে আমাদের থানায় ডেকে নিয়ে বলা হয় এটা সমাধান করে দেয়ার জন্য। সেগুলোর সমাধান করে থাকি। আমাদের রায়ে কারো কোন হস্তক্ষেপ যদিও নেই তবে গ্রাম আদালতের বিচার ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী স্বাধীন করার জন্য আমাদের দাবি থাকবে।
বিভিন্ন ইউনিয়নের মহিলাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, গ্রামের মহিলারা বেশীর ভাগ সময়ে নানা ধরনের সম্যসার মধ্যে পড়তে হয়। বিশেষত স্বামী মারা যাওয়ার পর গ্রামের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অনেকের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য নানাভাবে হয়রানি শুরু করেন। তাদের কথা এখন গ্রাম আদালতের মাধ্যমে মামলা দায়ের করে সেসব সমস্যা সমাধান করতে পারছেন তারা সহযেই। তাই মহিলাদের জন্য গ্রাম আদালত বিশেষ ভূমিকা বহন করে।
সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশরাফুল আলম খান বলেন, স্থানীয় মেম্বার চেয়ারম্যানরাই আলোচনা সাপেক্ষে গ্রাম আদালতকে আরো শক্তিশালী করতে পারেন। তবে জেল জরিমানার যে বিষয়টা আছে সেটা হল, তারা জেল দিতে পারেন না জরিমানা করতে পারেন এটা সত্য। যদি এমন মামলা হয় যার জেল দেয়ার উপযোগী, সে ক্ষেত্রে গ্রাম আদালত থেকে সংশ্লিষ্ট উচ্চ আদালতে সে মামলা প্রেরণ করার ব্যবস্থা রয়েছে।
গ্রাম আদালত শক্তিশালী রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, আর গ্রাম আদালত এমনিতেই অনেকটা শক্তিশালী আছে। অনেক কেইস আছে যা উচ্চ পর্যায়ের আদালত থেকে বদলি করে গ্রাম আদলতেও পাঠানো হয়। আর সে বিচারের রায় দেয় গ্রাম আদালত। তাই গ্রাম আদালতকে আরো শক্তিশালী করার জন্য স্থানীয় পর্যায়ের লোকজনই আলোচনা সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে।