মালয়েশিয়া পাঠানোর নামে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ নভেম্বর ২০১৪, ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে কক্সবাজারে বঙ্গোপসাগর দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর কথা বলে তাদের গভীর সমুদ্রে আটকে রেখে বড় অংকের মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ উঠছে।
মুক্তিপণের টাকা দিয়ে ফেরত আসা একজন বলেছেন, টাকা দেওয়ার পরও শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে ফিরতে হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে মৃতদেহও পাওয়া যায় না।
স্থানীয় প্রশাসন বলেছে, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ,থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া-চারটি দেশের দালালরা সংঘবদ্ধভাবে মানব পাচার এবং অর্থ আদায়ের এই অপরাধ করছে।
ফলে দেশি-বিদেশি দালাল চক্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের একক অভিযান কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে শেষপ্রান্তে নাফ নদীর সীমান্তের একটি পয়েন্টে দেখা যায়, নদীতে ছোট ছোট অসংখ্য নৌকা চলাচল করছে।
বিজিবি’র বক্তব্য অনুযায়ী, এ সব নৌকায় করে জেলেরা মাছ ধরে। আর অনেক সময় এই জেলের সাজ নিয়েই পাঁচজন-সাতজন লোককে নৌকায় করে সাগরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য।
দেশি-বিদেশি দালালরা এই অঞ্চলকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে, এমন অভিযোগও উঠছে।
বাংলাদেশিদের মতো রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের নাগরিকরাও দালালদের খপ্পরে পড়ছে। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া ই চারটি দেশে দালাল রয়েছে।
দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করা জয়নাল আবেদীন জানান, দালাল আমাকে নাফ নদীর একটি ঘাট থেকে ছোট নৌকায় নিয়ে সারারাত রেখেছিল। পরদিন অন্য দালাল আমাকে ছোট নৌকায় করে গভীর সমুদ্রে নিয়ে বড় জাহাজে তুলেছিল। সেই জাহাজে ১৭দিন রেখে আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে। পরে আমার সাথে আরও অনেককে দালালরা সাগরে ভাসিয়ে দিলে থাইল্যান্ডের দালালরা আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেয়।”
জয়নাল আবেদীন আরও জানান, “থাইল্যান্ডের দালালরা আমাদের ৯৫জনকে একটা ঘরে ৩২দিন আটকে রাখে। সেই সময় নির্যাতনে আমাদের মধ্যে ১৮ জন মারা গেছে।অন্যদিকে আমি মালয়েশিয়া পৌঁছে গেছি, এটা বলে আমার মা’র কাছ থেকে জোর করে ৯০ হাজার টাকা নিয়েছে।”
রঙ্গীখালী গ্রামেরই আসমা বেগম দালালের প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে একমাত্র ছেলে এবং বাড়িভিটে, সবই হারিয়েছেন।
চল্লিশ বছর বয়সী এই নারী তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলেকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন এঁকেছিলেন। মালয়েশিয়ায় ছেলে অনেক টাকা রোজগারের পর সেখানে যাওয়ার টাকা শোধ করবে, গ্রামেরই একজন দালালের এমন কথায় তিনি পাঁচ মাস আগে ছেলেকে ঐ দালালের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
পরে দালালের চাপে বাড়ির জমি বিক্রি করে দুই লাখ টাকা দিয়েও ছেলের খোঁজ পাননি।
অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে দালালরা বঙ্গোসাগরের এই অঞ্চলকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে এখন মূলত গভীর সমুদ্রে নিরীহ মানুষকে আটকে রেখে মুক্তিপণ বা টাকা আদায় করছে।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে এ ধরণের অভিযোগ জমা পড়ছে। উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী জানান, “অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে দালালরা বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে এখন মূলত গভীর সমুদ্রে নিরীহ মানুষকে আটকে রেখে মুক্তিপণ বা টাকা আদায় করছে। গভীর সমুদ্রে আটকে রেখে নির্যাতন করে, তা পরিবারকে মোবাইল ফোনে শুনিয়ে টাকা আদায় করা হয়। কখনও অল্প সংখ্যক মালয়েশিয়ায় পৌঁছালেও তাদের জায়গা হচ্ছে কারাগারে। প্রতিনিয়ত এমন তথ্যই তারা পাচ্ছেন।”
টেকনাফে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি’র ৪২ ব্যাটালিয়নের পরিচালক আবু জার আল জাহিদ জানান, বাংলাদেশিদের মতো রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের নাগরিকরাও দালালদের খপ্পরে পড়ছে।
তিনি জানান, “বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া এই চারটি দেশে দালাল রয়েছে। মালয়েশিয়ার যাওয়ার জন্য দুই লাখ টাকা লাগবে। এখন শুধু পাঁচ-দশ হাজার টাকা দিয়ে বাকিটা মালয়েশিয়া যাওয়ার পর দেওয়া যাবে। এ ধরনের নানান প্রলোভন দেখানো হয়। এরপর প্রলোভনে আকৃষ্ট মানুষকে গভির সমুদ্রে নিয়ে আটকে রেখে পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়।”
গ্রামগুলোতে স্থানীয়দের অনেকে দালাল চক্রের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ উঠছে। কিন্তু তাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন কাজ।
ক্ষতিগ্রস্তদের দিক থেকে অভিযোগ রয়েছে যে, পুলিশের কাছে অভিযোগ করে লাভ হয় না। তবে কক্সবাজারের পুলিশ বলছে, দেশি দালালরা সারাদেশে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে এবং তারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক নিয়ে এসে তাদের সমুদ্রে ধরে রেখে টাকা আদায় করছে।
টেকনাফ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোক্তার হোসেনের বক্তব্য হচ্ছে, দালালদের দেশি-বিদেশি নেটওয়ার্কের কারণে কোস্টগার্ড, বিজিবি এবং পুলিশ সমন্বিত অভিযান চালিয়েও এই অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ এবং বিজিবি’র স্থানীয় কর্মকর্তারা মনে করেন, নাফ নদী থেকে বঙ্গোপসাগর দিয়ে মানব পাচার এবং অর্থ আদায়ের এই অপরাধ বন্ধে মিয়ানমারসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে আলোচনা করে যৌথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।