দ্রুত হারে বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগী
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ নভেম্বর ২০১৪, ৬:৪৭ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
দ্রুত হারে দেশে বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। বিপাকজনিত রোগটিতে গ্রামের তুলনায় শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এ রোগে আক্রান্তের দিক দিয়ে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। দেশের ১০ শতাংশ মানুষ এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর বেশির ভাগই উচ্চবিত্ত। রোগের বিভিন্ন উপসর্গ বিরাজমান ২৩ শতাংশ মানুষের মধ্যে। উচ্চবিত্তদের মধ্যে আবার টাইপ ওয়ান বা ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। ফলে ইনসুলিনের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। বিস্তৃত হচ্ছে বাজার। বর্তমানে ইনসুলিনসহ ডায়াবেটিসের ওষুধের বাজার ছাড়িয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডায়াবেটিস প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়াই উত্তম।
ডায়াবেটিসের ধরন বা বিন্যাস প্রধানত দুই প্রকার। টাইপ ওয়ান বা ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস জন্মগত কিংবা পরিবেশগত কিছু কারণে হয়ে থাকে। অন্যদিকে টাইপ টু বা ইনসুলিননির্ভরহীন ডায়াবেটিস (এনআইডিডিএম) অতিরিক্ত ওজন, উচ্চশর্করা গ্রহণ ও কম আঁশযুক্ত খাদ্যাভ্যাসের কারণে হয়ে থাকে। টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যান্স অকার্যকর হয়ে পড়ে বিধায় অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য এ ধরনের রোগীদের ইনসুলিন গ্রহণ করতে হয়। অন্যদিকে টাইপ টু ডায়াবেটিস সাধারণত অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও অসেচতনতার কারণে হয় বলে অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি হিসেবে আইকোটস কোষগুলো কিছুটা সচল থাকে। এজন্য ইনসুলিন না নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করলেই ভালো হওয়া সম্ভব। গবেষণা তথ্যও বলছে, টাইপ টু ডায়াবেটিসে স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন করতে পারলে রোগের ৭০ শতাংশ নির্মূল সম্ভব।
বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) গবেষণার তথ্য বলছে, এ রোগের পেছনে এখন একজনকে খরচ করতে হচ্ছে তার মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ১০-১৫ শতাংশ। তাই টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগ কমানো গেলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যয় কমানো সম্ভব ১১ শতাংশ। কিন্তু রোগটি না কমে বরং দেশে দ্রুত হারেই বাড়ছে। ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত রোগটিতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। ২০০১-০৫ পর্যন্ত ৫ শতাংশ হলেও ২০০৬-০৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ শতাংশে। রোগটিতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ৩৫-৫০ বছর বয়সীরা। এক্ষেত্রে অসচেতনতাই প্রধান কারণ। পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ নারী ও ৫৯ শতাংশ পুরুষ এ রোগ সম্পর্কে সচেতন নন। অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ মানুষ এখনো ডায়াবেটিসের প্রকোপ সম্পর্কে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এছাড়া খাদ্যভ্যাসের পরিবর্তন, হাইপার টেনশন ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনকে দায়ী করা হয়েছে। অসচেতনতার মধ্যে রয়েছে নিয়মিত ব্লাড সুগার পরীক্ষা না করা, লিপিড প্রোফাইল, সিরাম ক্রিয়েটিনিন, প্রস্রাবে অ্যালবুমিন পরীক্ষা ও ব্লাড প্রেসার চেক না করা। এছাড়া জীবনযাপনে পরিবর্তনের কারণে শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, ওজন বেশি হয়ে যাওয়া, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ছে। রোগটি প্রতিরোধে ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীলতা যেমন বাড়ছে, তেমনি নানা রোগের কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব রোগের মধ্যে হূদযন্ত্র, রক্তনালির সমস্যা, কিডনি ও স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা এবং চোখের সমস্যা বাড়াচ্ছে।
অন্যদিকে রোগটি প্রকট আকার ধারণ করলেও সরকারিভাবে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। কিছু কার্যক্রম হাতে নেয়া হলেও তা পরিচালনা করা হচ্ছে অপর্যাপ্ত জনবল ও অবকাঠোমো দিয়ে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত ‘প্রিভিল্যান্স অব ডায়াবেটিস অ্যান্ড প্রি-ডায়াবেটিস অ্যান্ড দ্য রিস্ক ফ্যাক্টরস অ্যামং বাংলাদেশী অ্যাডাল্ট: এ নেশনওয়াইড সার্ভে’ শীর্ষক গবেষণায় এসব দুর্বলতার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গবেষণাটি পরিচালনার ক্ষেত্রে দেশের ১৭ হাজার ১৪১টি পরিবারের সাক্ষাত্কার নেয়া হয়। গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৩০ সালে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দেশের জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ ছাড়াবে।
এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যেই ১৪ নভেম্বর পালন হতে যাচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। এবার দিবসের প্রতিপাদ্য ‘স্বাস্থ্যসম্মত খাবার শুরু হোক সকালের নাশতা থেকে’। রোগটির জন্য জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ইনসুলিন আবিষ্কারক লর্ড ফেডরিকের জন্মদিন উপলক্ষে ২০০৭ সাল থেকে আইডিএফ ও ডব্লিউএইচও যৌথভাবে দিনটিকে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে পালন করছে।
এদিক দেশে এ রোগ বাড়তে থাকায় ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীলতাও বাড়ছে। বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির তথ্যমতে, দেশের ২০-২৫টি কোম্পানি ডায়াবেটিস রোগের ওষুধ বাজারজাত করছে। বর্তমানে এর বাজার ছাড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। তবে রোগটি প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ বেশি কার্যকর বলে জানান বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান।
তিনি বলেন, রোগটি দীর্ঘমেয়াদি, অবক্ষয়ী ও ব্যয়বহুল, যা অনেক মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করছে। এটি পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র এমনকি সারা বিশ্বের জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই রোগটি প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন জরুরি হয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। ব্যক্তিপর্যায়ে অবশ্যই জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও সঠিক পরিবেশ নিশ্চিতের পাশাপাশি পুষ্টিকর ও নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ, শরীরচর্চা, যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যশিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।