মোবাইল ব্যাংকিং — বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন ঝুঁকি?
প্রকাশিত হয়েছে : ৭ নভেম্বর ২০১৪, ১:২৪ অপরাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
খুব অল্প সময়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টাকা লেনদেনের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা বাংলাদেশে এখন বেশ পরিচিত। ২০১০ সালে বেসরকারি ব্যাংকগুলো অনুমোদনের ভিত্তিতে এই মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করে। মূলত দেশের স্বল্প আয়ের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার জন্য দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই উদ্যোগ নেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এখন গড়ে প্রতিদিন ৩৩৩ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায়। কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের এই সহজ পদ্ধতি অর্থনীতিতে নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে।
অধিকাংশ মানুষ কোন অ্যাকাউন্ট ছাড়াই লেনদেন করছেন প্রতিদিন। খুব সহজে ও দ্রুত – টাকা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পাঠানোর এই মাধ্যম এখন অনেকেই পছন্দ করছেন।
স্বল্প আয়ের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং সহজে কম সময়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে সহজে টাকা লেনদেনের এই প্রক্রিয়া দেশে শুরু হয় ২০১০ সালে।
এ ব্যবস্থায় মূলত গ্রাহককে মোবাইলে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। এই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেই অন্য কোন মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে পারেন তিনি। তবে এই নগদ টাকা তুলতে মাঝখানে থাকেন একজন এজেন্ট। তারা মূলত ছোট ব্যবসায়ী যারা নিজের দোকান ঘরেই লাইসেন্স নিয়ে থাকেন ব্যাংকের কাছ থেকে।
মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকা এই এজেন্টরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা আদান প্রদান করে থাকেন।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অনুমোদনের ভিত্তিতে সাড়ে চার লক্ষের বেশি এজেন্ট এই নগদ টাকা লেনদেনের কাজ করছেন। আর বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে এখন গড়ে প্রতিদিন ৩৩৩ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে এই মোবাইলের মাধ্যমে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বিপুল পরিমাণের অর্থের লেনদেন দেশের অর্থনীতিতে কি অর্থ বহন করছে? মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তারা বলছেন এক কথায় এর ফলে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে ফলে অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
তবে এর কিছু ঝুঁকির কথাও উল্লেখ করছেন তারা। মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে গবেষণা করছে পিআই স্ট্রাটেজি কনসালটিং। প্রতিষ্ঠানটির একজন গবেষক পিয়াল ইসলাম বলছিলেন মোবাইল ব্যাংকিং এর সবচেয়ে বড় ঝুঁকির জায়গা এখানে গ্রাহকদের সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য লিপিবদ্ধ থাকছে না। তিনি বলছিলেন “এজেন্টের মাধ্যমে যখন টাকা লেনদেন হচ্ছে সেটার কোন ডক্যুমেন্ট থাকছে না। ব্যাংক ব্যবস্থায় কিন্তু সব কিছুর ডক্যুমেন্ট থাকে। এটা খুব শীগগিরই বড় আকারে খারাপ পর্যায়ে যেতে পারে। আমার একটা বড় আশঙ্কা হচ্ছে ওটিসি বা এজেন্টের মাধ্যমে টাকা লেনদেন বন্ধ করতে না পারলে পাঁচ দশ বছরে অনেক বড় ধরনের ঝুঁকি বয়ে নিয়ে আসতে পারে”। তিনি আরও বলেন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার আওতায় আনার যে লক্ষ্য নিয়ে সেবাটি শুরু করা হয়েছিল তার চার বছর পর দেখা যাচ্ছে ৮০/৯০ শতাংশ টাকা লেনদেন হয় যাদের কোন অ্যাকাউন্ট নেই।
সেই অর্থে ব্যাংকিং ব্যবস্থার আওতায় আসছে না তারা। এছাড়া এ ব্যবসার মাঠ পর্যায়ের অন্যতম চাবিকাঠি যে এজেন্ট তাদের প্রতারিত ও ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। তাদের ব্যবহার করা মোবাইল অ্যাকাউন্ট আসা-ভুয়া এসএমএসের শিকার হয়ে কয়েকজন এজেন্ট খুইয়েছেন কয়েক হাজার টাকা। তবে গবেষকরা বলছেন এর সংখ্যা নিতান্তই কম।
দেশে সবার আগে মোবাইল ব্যাংকিং শুরু করে বেসরকারি ব্যাংক ডাচ বাংলা ব্যাংক। ব্যাংকটির ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর আবুল কাশেম মো. শিরিন অবশ্য এর বিভিন্ন দুর্বল দিক এবং ঝুঁকির কথা স্বীকার করে বলেন প্রথম অবস্থায় মোবাইল ব্যাংকিং সম্পর্কে অবগত করার জন্য কিছু বিষয় শিথিল করা হয়েছিল। তবে নিয়মগুলো এখন কঠিন করার সময় এসেছে বলে তিনি মনে করেন। শিরিন বলেন “ আমাদের এজেন্টগুলো বেশ কিছু বিষয় বাইপাস করছে। এর অর্থ দাড়ায়, যে টাকা পাঠাচ্ছে এবং যে গ্রহণ করছে তার কোন রেকর্ড থাকছে না। যেটা এক কথায় অবৈধ।
আর ফাইন্যানশিয়াল ইনক্লুশন বলতে যেটা বোঝানো হচ্ছে সেটাও হচ্ছে না। এখন আমাদের সময় এসেছে সিস্টেমটাকে টাইট করার”।
২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ২৮ টি ব্যাংককে অনুমোদন দেয় মোবাইল ব্যাংকিং এর। এর মধ্যে ১৯টি ব্যাংক মাঠ পর্যায়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এদিকে সম্প্রতি দি ইকোনমিস্ট পত্রিকা মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় শীর্ষ দেশগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। তাতে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি তাদের অবস্থান আরও সামনের দিকে।
কিন্তু দ্রুত প্রসারিত এই মোবাইল ব্যাংকিং সেবার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে যে দিকগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে সেসব বিষয়ে কি পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক?
এমন প্রশ্নে ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান বলেন “মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা বাংলাদেশে ডেভেলপ করছে। একদিনে সব ঠিক হয়ে যাবে না। এজেন্টদের মাধ্যমে যেটা হচ্ছে সেটাকে আমরা নিরুৎসাহিত করছি। আমরা ব্যাংকগুলো বলছি প্রতিনিয়ত এগুলো তদারকি করতে”।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে বেশি নিয়ম কানুনের বেড়াজাল তৈরি হলে তাদের লক্ষ্য যে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তারা এই ব্যবস্থায় নিরুৎসাহিত হয়ে পরতে পারে।
মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে মোবাইলের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর এই পদ্ধতি দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে দেশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকটির হিসেব অনুযায়ী মোবাইল ব্যাংকিংএর গ্রাহক সংখ্যা বর্তমানে দুই কোটির বেশি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন এর ঝুঁকির দিকগুলো এখন থেকে পর্যবেক্ষণে রেখে ব্যবস্থা নিলে ভবিষ্যতে মোবাইল ফোনভিত্তিক এই ব্যাংকিং সেবা দেশের অর্থনীতিতে আরও অর্থবহ হতে পারে।