ইন্টারনেটের ট্রোজান ভাইরাস
প্রকাশিত হয়েছে : ৪ নভেম্বর ২০১৪, ৮:৩৬ পূর্বাহ্ণ
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ডেস্ক ::
ইন্টারনেটে কোনো ওয়েবসাইটে গেলেই দেখতে পাবেন ব্যানারে নানা কোম্পানির নানা অফার, লিংক-এর পর লিংক। সেই সঙ্গে হয়ত রয়েছে ফেসবুক, টুইটার, গুগল-এর ‘বাটন’। এদের অধিকাংশই কিন্তু ট্রোজান ভাইরাস হিসেবে কাজ করছে।
সব ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ব্যাপারটা জানেন: কোনো ওয়েবসাইট খুললেই তার সঙ্গে না চাইতেই নানা ধরনের উইন্ডো উঠে আসে। তাতে নানা রকমের অফার: মেল অর্ডার সংস্থা, কিংবা ইলেকট্রিক কোম্পানি, কিংবা টেলিফোন কোম্পানির নিত্যনতুন অফার – সুন্দর করে ভিডিও, ছবি আর বিজ্ঞাপন দিয়ে সাজানো। মজার কথা, এই সব অফার যেন একেবারে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ব্যক্তিত্ব ও স্বভাব-চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে করা। তার ফলে অনেক ইউজার-এর মনে হতে পারে, কে বা কারা তাদের উপর বিশেষ নজর রাখছে!
একটি ওয়েবসাইটে যাওয়ার অর্থ শুধু সেই সংক্রান্ত বিষয়বস্তুই নয়, সঙ্গে একগাদা বিজ্ঞাপনের ব্যানার এসে জড়ো হয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কম্পিউটারে, যা থেকে অ্যাডভার্টাইজিং কোম্পানিগুলি ব্যবহারকারীর সার্ফিং আচরণ বিশ্লেষণ করতে পারে। কার্লসরুয়ে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের টিল নয়ডেকার বলেন: ‘‘নিজের ব্রাউজারে তৃতীয় পক্ষের এই ধরনের তথ্য – যেমন ধরুন বিজ্ঞাপনের ব্যানার – ডাউনলোড করার অর্থ যে, আমি যে আইপি অ্যাড্রেস থেকে সার্ফ করছি, সে ঠিকানা সেই তৃতীয় পক্ষের কাছে পৌঁছে যাবে। পরে বিজ্ঞাপনদাতা সেই ঠিকানায় গিয়ে দেখতে পাবে, সেখানে কী তথ্য আছে এবং সেই পন্থায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ও সেই ব্যবহারকারীর পছন্দ-অপছন্দের মধ্যে যোগসূত্রটি আবিষ্কার করতে পারবে।”
সার্ফিং সংক্রান্ত তথ্য
কার্লসরুয়ে ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-তে তথ্য-প্রযুক্তির চার ছাত্র. অলিভার, আরিস, ফাবিয়ান ও মিশায়েল একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করেছেন, যা থেকে দেখা যায়, কোন কোন কোম্পানি ইউজারের সার্ফিং সংক্রান্ত তথ্য পেতে পারে এবং সারা বিশ্বে কোথায় কোথায় সেই তথ্য গিয়ে পৌঁছচ্ছে। এদের চারজনই স্নাতকোত্তর গবেষণায় ব্যস্ত এবং তাদের রিসার্চ গাইড হলেন টিল নয়ডেকার। নয়ডেকার-এর ভাষ্যে: ‘‘এই সফটওয়্যারের লক্ষ্য হলো এমন সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যকে দৃশ্যমান করা, যা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা সাধারণত দেখতে পান না। অর্থাৎ বিশ্বের একটি মানচিত্রে দেখানো হচ্ছে, ব্যবহারকারীর তথ্য কী পরিমাণে বিশ্বের কোন কোন স্থানে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে। একজন সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর যে বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই।”
যে সব থার্ড পার্টি সাপ্লায়ার সঠিক বিজ্ঞাপন দেবার উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কম্পিউটারে তথ্যের আদানপ্রদানের উপর নজর রাখছে, তাদের শনাক্ত করে ও তাদের লিংক-গুলো একত্র করে বিশ্লেষণ করাই হল কার্লসরুয়ে-র সফটওয়্যারটির বৈশিষ্ট্য। সার্ফিং-এর সময় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নিজের সম্পর্কে কতটা তথ্য প্রদান করছেন, তা তিনি বিশ্বের একটি মানচিত্র থেকে দেখতে পাবেন। তিনি যে সব ওয়েবসাইটে গেছেন, সেখান থেকে সেই তথ্য সারা বিশ্বে ঘুরছে, যেমন সুইডেন, তেমনই আয়ারল্যান্ডে স্টোর করা হচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন মুলুকের বড় বড় ইন্টারনেট সংস্থাগুলি সেই তথ্য জমা করছে। যতদিন পর্যন্ত সেই তথ্য শুধু বিজ্ঞাপনের কল্যাণে ব্যবহার করা হয়, তাতে আপত্তি না করলেও চলে – কিন্তু গোয়েন্দা তথা গুপ্তচর সংস্থাগুলো যদি সেই তথ্যে হাত বসায়? নয়ডেকার বলেন: ‘‘ইউজার যদি এমন কোনো দেশের বাসিন্দা হন, যেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক আমাদের মতো নয় – এবং ইউজার যদি সরকারের সমালোচক কোনো পক্ষের ওয়েবসাইটে যান, তাহলে সরকার খুঁজে বার করতে পারেন, কোন নাগরিক ঠিক কোন তথ্যের খোঁজ করছেন। এমনকি সরকারের পক্ষে সে ধরনের নাগরিকদের শনাক্ত করাও সম্ভব।”
লগ-ইন করা থাকলে বিপদ
কোন ইউজার কোন ওয়েবসাইটে যাচ্ছেন, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব হয়েছে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক-গুলো চালু হওয়ার পর। কোনো পরিচিত কিংবা অপরিচিত ওয়েবসাইটে ফেসবুক, টুইটার এবং গুগল-এর ‘বাটন’-গুলো ট্রোজান ভাইরাসের মতো কাজ করে: সেগুলো ক্লিক না করলেও তারা ইউজার সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। আর যদি ইউজার যুগপৎ কোনো সোশ্যাল নেটওয়ার্কে লগ-ইন করে থাকেন, তাহলে তো সেটা আরো বিপজ্জনক! নয়ডেকার সাবধান করে দিলেন: ‘‘ফেসবুক প্রোফাইল না থাকলে ইউজার অন্তত খানিকটা অজ্ঞাত থাকেন: থার্ড পার্টি সাপ্লায়ার বা তৃতীয় পক্ষ বড়জোর জানতে পারে যে, কোনো একজন ইউজার কোনো বিশেষ ওয়েবসাইটে গেছেন। কিন্তু যদি ইউজারের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকে এবং তিনি লগ-ইন করে থাকেন, এমনকি পরে কোনো সময়েও, তাহলে ফেসবুক-এর পক্ষে ইউজারের নিজের অ্যাকাউন্টের তথ্যের সঙ্গে সেই অ্যাকাউন্টের লাইক-বাটন-গুলির তথ্যের যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব।”
অ্যাড-ব্লকার তোমাকে লক্ষ্য রাখছে?
ফেসবুক প্রোফাইলের সঙ্গে ইউজারের সার্ফিং আচরণের যে যোগাযোগ, তা ফেসবুকের পক্ষে বিশেষভাবে মূল্যবান। ‘অ্যাড-ব্লকার’, অর্থাৎ বিজ্ঞাপন প্রতিরোধী প্রোগ্রাম দিয়ে কি ‘আত্মরক্ষা’ করা যেতে পারে? দৃশ্যত নয়, জানালেন নয়ডেকার: ‘‘অ্যাড-ব্লকার’-এর সমস্যা হলো, সেগুলো সাধারণত প্লাগ-ইন হিসেবে ব্রাউজার-এ থাকে। অর্থাৎ ছোট ছোট প্রোগ্রাম, যা সরাসরি ইউজারের ব্রাউজারের মধ্যেই কাজ করে এবং সেই পদ্ধতিতে – অন্তত তর্কের খাতিরে – ইউজারের গোটা সার্ফিং আচরণের উপর নজর রাখতে পারে ও তার খবরাখবর কোনো তৃতীয় পক্ষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে।”
অর্থাৎ জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। কিন্তু ইউজাররা যতদিন ইন্টারনেটের কাছ থেকে নিখর্চায় নানা পরিষেবা প্রত্যাশা করবেন, ততদিন কিছুই বদলাবে না, কেননা বিনামূল্যে কিছুই পাওয়া যায় না। আমরা ঐ নিখর্চার পরিষেবার মূল্য চোকাই আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে। কার্লসরুয়ে-র সফটওয়্যার আমাদের সেই অনিচ্ছাকৃত তথ্যের প্রবাহ সম্পর্কে কিছুটা সচেতন করে তোলে বৈকি!