আধা ডিজিটাল ও আধা অ্যানালগ সিস্টেমের কারণেই জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়
প্রকাশিত হয়েছে : ৩ নভেম্বর ২০১৪, ৭:১২ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও সঞ্চালন ব্যবস্থা এখনো ভঙ্গুর। সঞ্চালন লাইনে এ দুর্বলতার কারণে জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকছে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো যথেষ্ট প্রস্তুতিও নেই। সব মিলিয়ে ভঙ্গুর সঞ্চালন ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে খোদ সরকারের মধ্যে।
বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ৬২ শতাংশ। অথচ সঞ্চালন লাইন বেড়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ। আর বিতরণ লাইন বেড়েছে ১১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে ডিজিটালাইজেশনের কাজ চলছে মন্থরগতিতে। লোড নির্ধারণের ক্ষেত্রে সব সাবস্টেশন থেকে প্রকৃত চাহিদা পাওয়া যায় না। এতে আশঙ্কা থেকে যায় বিপর্যয়ের। এছাড়া ভারত থেকে আনা বিদ্যুৎ আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে গেলেও জাতীয় গ্রিড বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
ভেড়ামারায় ভারত-বাংলাদেশ সঞ্চালন লাইনে ত্রুটির কারণে গত ১ নভেম্বর শনিবার জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় নেমে আসে। এতে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে সারা দেশ। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও ওই বিপর্যয়ের জন্য সঞ্চালন ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দায়ী করেছেন। গতকাল রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘শনিবারের ঘটনার জন্য আমাদের সঞ্চালন লাইনই দায়ী। এর অন্য কোনো কারণ নেই। এজন্য ভারতও দায়ী নয়। আমাদের সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন খুবই দুর্বল।’
জানা যায়, উৎপাদনকেন্দ্র থেকে গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজটি করা হয় চাহিদার লোড নির্ধারণের মাধ্যমে। কোনো কারণে লোডের চেয়ে কম বা বেশি বিদ্যুৎ গ্রিডে দেয়া হলেই বিপর্যয় দেখা দেয়। তবে ৫০ থেকে ১০০ মেগাওয়াট তারতম্য হলে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। তখন একটি অঞ্চল বিদ্যুৎহীন থাকে। কিন্তু বেশি তারতম্য হলেই বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজটি করে ন্যাশনাল লোড ডেসপাচ সেন্টার (এনএলডিসি)। কেন্দ্রটি দেশের সব সাবস্টেশন থেকে চাহিদার লোড পরিমাপ করে। এর মধ্যে অনেক সাবস্টেশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে এনএলডিসির সঙ্গে যুক্ত নেই। এক্ষেত্রে স্থানীয় অফিস থেকে চাহিদার আনুমানিক হিসাব নেয়া হয়। আবার বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রগুলোও শতভাগ স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় নেই। তাই উৎপাদনে প্রকৃত হিসাব পেতেও টেলিফোনের ওপর ভরসা করতে হয় এনএলডিসিকে। প্রকৃত লোড নির্ধারণ করতে না পারলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকেই যায়।
বিদ্যুৎ বিভাগের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক মাহবুব সারোয়ার-ই-কায়নাত এ প্রসঙ্গে জানান, আধা ডিজিটাল ও আধা অ্যানালগ সিস্টেমের কারণেই সংকটে পড়ছে বিদ্যুৎ খাত। ভবিষ্যতেও বিপর্যয়ের শঙ্কা আছে। তবে পুরোপুরি ডিজিটাল হয়ে গেলে গ্রিড বিপর্যয়ের আশঙ্কা দূর হবে। লোড নির্ধারণ স্বয়ংক্রিয় না হওয়ায় ডিজিটাল রিলে সিস্টেম যথাযথভাবে কাজ করতে পারে না।
সূত্র জানায়, অনেক দেশে গ্রিডকে একাধিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়ে থাকে। আবার অনেক দেশে একটি জাতীয় গ্রিড থাকে। বাংলাদেশে আগে দুটি গ্রিড থাকলেও বর্তমানে তা একীভূত অবস্থায় রয়েছে। গ্রিড বিপর্যয় হলে তা সংশোধনে সাধারণত ২ থেকে ১৮ ঘণ্টা সময় লাগে। বাংলাদেশ ৮-১০ ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পেরেছে। যদিও এটি ২ ঘণ্টায় সমাধান করা যেত বলে মনে করছেন অনেকে। দায়িত্বশীলদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও অভিজ্ঞতার অভাবেই দেরি হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। এর আগে সিডরে সৃষ্ট বিপর্যয়ে কম সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটে। এমনকি ১৯৯৪-৯৫ সালে ট্রিপজনিত সমস্যায় নিয়মিত ছোট আকারের গ্রিড বিপর্যয় হতো। দ্রুততম সময়ে তা সংশোধন করা হতো। এবার অনেক বছর পর দেশে বড় ধরনের গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটল।
গত শনিবার দেশে বড় ধরনের গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। তাতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সারা দেশ। ৮ ঘণ্টা পর ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। শনিবারের ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পর গতকাল সকালে রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের কোথাও বিদ্যুতের সমস্যা নেই। ভবিষ্যতে এ ধরনের সংকট সামাল দিতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। বিদ্যুৎ বিভাগ ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির পৃথক দুই তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পিজিসিবির পদস্থ দুই কর্মকর্তা ভারত যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল বলেন, দেশের কোথাও বিদ্যুতের কোনো সমস্যা নেই। কোথাও এ ধরনের সমস্যা থাকলে তা আঞ্চলিক কারণে হতে পারে। গ্রিড বিপর্যয়ের বিষয়টি পুরোপুরি কারিগরি। তাই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না।
জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের সার্কিট ব্রেকারে ত্রুটি দেখা দিলে শনিবার বেলা ১১টা ২৭ মিনিটে ভারত-বাংলাদেশ বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। একসঙ্গে জাতীয় গ্রিডে ৪৬২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে বিপর্যয় দেখা দেয়। একে একে অন্যান্য লাইন ট্রিপ করতে থাকে। এতে সারা দেশের সব বিদ্যুকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে বিকাল ৪টা ২৭ মিনিটে আবারো ভারত-বাংলাদেশ সাবস্টেশন চালু করতে গেলে লাইন ট্রিপ করে। ফলে দুপুরের পর থেকে আংশিক স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও বিকালে আবারো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সারা দেশ।