মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড
প্রকাশিত হয়েছে : ২ নভেম্বর ২০১৪, ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক ও চট্টগ্রাম গণহত্যার হোতা জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
আজ রোববার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২এ রায় দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। মামলার কার্যক্রম শেষ হওয়ার প্রায় ছয় মাস পর আজ এ রায় ঘোষণা করা হলো।
জামায়াতের রাজনীতিতে অর্থের জোগানদাতা হিসেবে পরিচিত মীর কাসেমের রায় ঘোষণার দিন ধার্য করে গত বৃহস্পতিবার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। পরদিন শুক্রবার মীর কাসেমকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে আজ সকাল নয়টা ৪০ মিনিটে মীর কাসেমকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় আনা হয়। সকাল ১০টা ৪৪ মিনিটে তাঁকে হাজতখানা থেকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় আনা হয়।
সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের এজলাসে আসেন ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারপতি।
ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় মীর কাসেম সকাল ১০টা ৫৮ মিনিটে সূচনা বক্তব্য দিয়ে রায় পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি বলেন, গত ৪ মে এই মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। আজ রায় দেওয়া হচ্ছে। মামলায় মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি অভিযোগের ক্ষেত্রে আমার একমত পোষণ করেছি। একটির ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে। রায় ৩৫১ পৃষ্ঠার।
১৪ অভিযোগ:
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠন করা হয়। এর মধ্যে ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগ অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার। বাকি ১২টি অভিযোগ অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতনের।
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম শহর শাখা ইসলামী ছাত্রসংঘের (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন) সভাপতি মীর কাসেম স্থানীয় আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। তিনি কেবল নিজেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেননি; একই সঙ্গে তিনি তাঁর অধীনস্থদের অপরাধ সংঘটনে নির্দেশ দিয়েছেন।
সবগুলো অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার দাবি করে মীর কাসেমের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চায় রাষ্ট্রপক্ষ। পক্ষান্তরে আসামিপক্ষ দাবি করে, রাষ্ট্রপক্ষের কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তাই মীর কাসেমের খালাস আশা করে তারা।
মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আটজনকে হত্যার অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। তাঁর বিরুদ্ধে ১১ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালে পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর যেকোনো দিন মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে চট্টগ্রাম শহরের অজ্ঞাত স্থান থেকে অপহরণ করে আলবদর সদস্যরা। পরে মীর কাসেমের নির্দেশে জসিমকে ডালিম হোটেলে নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে নির্যাতন ও ২৮ নভেম্বর হত্যা করা হয়। পরে সেখানে নির্যাতনে নিহত আরও পাঁচজনের সঙ্গে জসিমের লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
১২ নম্বর অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের নভেম্বরে মীর কাসেমের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা চট্টগ্রামের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হাজারী গলির বাসা থেকে রঞ্জিত দাস ও টুন্টু সেনকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। পরে তাঁদের হত্যা করে লাশ গুম করা হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগী রাজাকার-আলবদররা হাজারী গলির ২৫০ থেকে ৩০০ দোকান লুট ও অগ্নিসংযোগ করে।
মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ১ থেকে ১০ নম্বর এবং ১৩ ও ১৪ নম্বর এই ১২টি অভিযোগে ২৪ জনকে অপহরণের পর আটক ও নির্যাতনের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব অভিযোগ অনুসারে, ৮ নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গা থেকে অপহরণের পর তাঁদের ডালিম হোটেল, সালমা মঞ্জিল বা আছদগঞ্জের নির্যাতন কেন্দ্রে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের শিকার ২৪ জনের নাম এসব অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে। মীর কাসেমের নেতৃত্বে ও নির্দেশে তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন আলবদর বাহিনী এসব অপহরণ ও নির্যাতন করে।
ফিরে দেখা ১৯৭১-২০১৪
রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা নথিপত্র অনুসারে, বর্তমানে ৬২ বছর বয়সী মীর কাসেমের পৈতৃক বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলায়। তবে বাবার চাকরির সূত্রে তিনি ছোটবেলা থেকে চট্টগ্রামে থাকতেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের (বর্তমান নাম ইসলামী ছাত্রশিবির) চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি ছিলেন। ৭ নভেম্বর তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘ নাম বদলে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে। মীর কাসেম ছিলেন ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ওই সময় থেকে তিনি জামায়াতের রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে দলটির অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত করার উদ্যোগ নেন।
১৯৮০ সালে মীর কাসেম রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী নামের একটি বিদেশি বেসরকারি সংস্থার এ দেশীয় পরিচালক হন। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি জামায়াতের শূরা সদস্য। দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেম জামায়াতের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। জামায়াতের অর্থের সবচেয়ে বড় জোগানদাতাও তিনি। এ ছাড়া তিনি দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান, ইবনে সিনা ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য।
২০১২ সালের ১৭ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মীর কাসেমকে গ্রেপ্তার করে। গত বছরের ১৬ মে রাষ্ট্রপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল-১। পরে মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৪ জন ও আসামিপক্ষে তিনজন সাক্ষ্য দেন। ২৩ এপ্রিল সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়। গত ৪ মে দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হলে রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়। আজ রায় ঘোষণা করলেন ট্রাইব্যুনাল।
নিরাপত্তা:
মীর কাসেমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও এর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নেন। হাইকোর্ট ও ট্রাইব্যুনালে প্রবেশের সবগুলো ফটকে পুলিশ ও র্যাব অবস্থান নেয়। ভেতরে প্রবেশের ক্ষেত্রে পরিচয় নিশ্চিত করা হয়।
দোয়েল চত্বর থেকে হাইকোর্ট মাজার-সংলগ্ন ফটক পর্যন্ত সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। হাইকোর্ট মাজার-সংলগ্ন ফটকের বাইরে অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সাঁজোয়া যান।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার: মীর কাসেমের মামলাটি ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ১১তম রায়। এর আগে ট্রাইব্যুনাল-১ চারটি ও ট্রাইব্যুনাল-২ ছয়টি মামলার রায় দিয়েছেন। এটি ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া সপ্তম মামলার রায়।
দুই ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়গুলোর মধ্যে তিনটি ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোটের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল-১-এর দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ।
আর গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল-২-এর দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। ১২ ডিসেম্বর রাতে ওই রায় কার্যকর করা হয়।
এ ছাড়া বিএনপির সাবেক নেতা আবদুল আলীম মারা যাওয়ায় তাঁর মামলাটি আপিল বিভাগ বাতিল করেছেন। ট্রাইব্যুনাল-২ তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল-১-এর রায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমও কারাগারে আটক অবস্থায় ২৩ অক্টোবর মারা যান। নিয়ম অনুসারে আপিল বিভাগে বিচারাধীন তাঁর মামলাটিও আর চলবে না।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এ পর্যন্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলবদর বাহিনীর দুই নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান, জামায়াতের সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আযাদ, বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।