জামায়াতে ইসলামীর আমির নিজামীর রায় বুধবার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ অক্টোবর ২০১৪, ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, পরিকল্পনা, উস্কানি, সহায়তাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলার রায় ঘোষণা করা হবে বুধবার।
আজ ২৮ অক্টোবর মঙ্গলবার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দিন ঠিক করেন।
প্রায় সাত মাস ধরে ঝুলছে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর এ মামলার রায়। গত ২৪ জুন এ মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ নিজামীর অসুস্থতার কারণে সেদিন রায় ঘোষণা না করে এটি ফের অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়।
এর আগে গত বছরের ১৩ নভেম্বর প্রথমবারের মতো এই মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। কিন্তু রায় ঘোষণার আগেই অবসরে চলে যান ট্রাইব্যুনাল-১-এর তত্কালীন চেয়ারম্যান। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল অধিকতর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে দ্বিতীয় দফায় গত ২৪ মার্চ মামলার রায় অপেক্ষমাণ রাখেন।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এটি হবে ট্রাইব্যুনালের দশম রায়। ২০১২ সালের ২৮ মে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-১ নিজামীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ ১৬টি অভিযোগ আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠন করেন তার বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের উসকানি ও সহায়তা দেওয়া এবং পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়।
২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপন করা অভিযোগপত্রে নিজামীর বিরুদ্ধে পাবনার বেড়া থানায় বুশলিকা গ্রাম ঘেরাও করে ৭০ জনকে গুলি করে হত্যা ও ৭২টি বাড়িতে আগুন দেওয়া, ডেমরা ও বাউশখালী গ্রামে ৪৫১ জন নিরীহ নারী-পুরুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা, সাঁথিয়া উপজেলার করমচা গ্রামে মন্দিরের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিজামীকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে অভিযুক্ত করা হয়। বলা হয়, নিজামী ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই সব কর্মকাণ্ডের উস্কানিদাতা, মদদদাতা ও পরিকল্পনাকারী।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে ২০১০ সালের ২৯ জুন নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২ আগস্ট তাকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খানের জবানবন্দি উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে ২০১২ সালের ২৬ আগস্ট এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২৬ জন সাক্ষ্য দেন।
নিজামীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন চারজন। সাক্ষ্য ও জেরা শেষে ৩ থেকে ৬ নভেম্বর প্রসিকিউশনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। এরপর ৭ নভেম্বর থেকে চারদিন আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করা হলেও নিজামীর আইনজীবীরা আসেননি।
অভিযোগ গঠনের আদেশে বলা হয়, ১৯৪৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মতিউর রহমান নিজামী। জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রধান হিসেবে একাত্তরে তিনি ছিলেন আলবদর বাহিনীর প্রধান। স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর দমন-পীড়ন চালাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটিতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। ঘোষণা করা হবে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্ব্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার এ আদেশ দেন।
গত ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বিগত চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড হয়।
যত অভিযোগ
১. একাত্তরের ৩ আগস্ট নিজামী চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে শহর ছাত্রসংঘের এক সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেন। তিনি সেখানে পাকিস্তান রক্ষার পক্ষে বক্তব্য দেন। ওই সভায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রসংঘের সভাপতি আবু তাহের হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার আদেশ দেন। নিজামী ওই সভায় উপস্থিত থেকেও আবু তাহেরের বক্তব্যের বিরোধিতা না করে মৌন সম্মতি দেন।
২. একই বছরের ২২ আগস্ট নিজামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল-মাদানি স্মরণসভায় বক্তব্য দেন। তিনি এ সভায় দলীয় নেতাকর্মীদের স্বাধীনতাকামীদের নিশ্চিহ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করেন। এরপর তারা সারাদেশে সংগঠিত হয়ে অপরাধ করতে থাকেন। যার দায় নিজামীর।
৩. একই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে এক ছাত্রসমাবেশে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন নিজামী।
৪. একই বছরের ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর যশোর বিডি হলে ছাত্রসংঘের সভায় তিনি জিহাদের সমর্থনে বক্তব্য দেন। নিজামী ওই সভায় বক্তব্য দিয়ে নিরীহ স্বাধীনতাকামী বাঙালি হত্যার নির্দেশ দেন।
৫. একই বছরের ১৪ মে নিজামীর নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার, আলবদররা পাবনার ডেমরা ও বাউসগাতি গ্রাম ঘেরাও করে। এরপর সাড়ে চার শতাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে এক জায়গায় জড়ো করে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। সেখানে নারীদের ধর্ষণও করা হয়।
৬. নিজামীর নির্দেশে পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগিতায় একই বছরের ৮ মে পাবনার সাঁথিয়া থানার করমজা গ্রামে লোক জড়ো করে নির্বিচারে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অসংখ্য লোককে হত্যা করা হয়। নারীদের ধর্ষণ করা হয়।
৭. একই বছরের ২৭ ও ২৮ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়া থানার ধোলাউড়ি গ্রামে ডা. আবদুল আওয়ালের বাড়ি ও আশপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ৩০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেখান থেকে চারজনকে ধরে নিয়ে ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। সেখানে শাহজাহান আলী নামে একজনকে গলা কেটে ফেলে রাখা হয়। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান।
৮. ১৬ এপ্রিল ঈশ্বরদি থানার আটপাড়া ও বুথেরগাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে ১৯ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
৯. ১০ জুন আতাইকুলা থানার মাতপুর গ্রামের মাওলানা কছিমউদ্দিনকে ধরে নিয়ে ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়।
১০. ৯ আগস্ট পাবনা শহরের নূরপুর ওয়াপদা মোড় থেকে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মাজেদসহ দু’জনকে ধরে নিয়ে হত্যার পর পাবনা সুগার মিলের পাশে নিয়ে লাশ ফেলে রাখা হয়।
১১. ৩ ডিসেম্বর বেড়া থানার বিছাখালী গ্রামে হামলা চালিয়ে ৭০ জনকে হত্যা করা হয়।
১২. আগস্টের কোনো এক সময় সাঁথিয়ার সোনাতলা গ্রামে হামলা চালিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
১৩. ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মে মাসে ঢাকার মোহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা ক্যাম্প স্থাপনের পর সেখানে গোলাম আযম ও নিজামী নিয়মিত যাতায়াত করতেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করতেন। তারই ফসল হিসেবে সারাদেশে হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
১৪. ৩০ আগস্ট রাতে পুরনো এমপি হোস্টেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্পে বন্দি জালাল, রুমী, বদিসহ বেশ কয়েকজনকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন মতিউর রহমান নিজামী। এরপর তাদের হত্যা করা হয়।
১৫. একই বছরের ৫ মে থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে পাবনার সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্পে মাঝে মধ্যে নিজামী যেতেন। সেখানে তিনি রাজাকার কমান্ডার সামাদ মিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য শলাপরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন।
১৬. আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিজামী একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ঊষালগ্নে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়।