মান পরীক্ষণ ছাড়াই সিএফএল বাল্ব বাজারে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ অক্টোবর ২০১৪, ৮:৪০ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
মান পরীক্ষা ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড় হচ্ছে আমদানিকৃত কমপ্যাক্ট ফ্লুরেসেন্ট ল্যাম্প (সিএফএল) বাল্ব। জনস্বাস্থ্য ও গ্রাহকস্বার্থ রক্ষার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পণ্যটি ছাড় করার আগে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) ল্যাবে এর মান পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এতে চীন থেকে আনা নিম্নমানের বাল্ব ছড়িয়ে পড়ছে বাজারে।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্দর দিয়ে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৬৫৭ কেজি সিএফএল বাল্বের শুল্কায়ন হয়েছে। অথচ এ সময়ে মান পরীক্ষার জন্য বিএসটিআইয়ের কাছে মাত্র পাঁচটি চালানের নমুনা পাঠানো হয়েছে। সাধারণত সিএফএল বাল্বের প্রতি চালানে এক থেকে পাঁচ হাজার কেজি বাল্ব আমদানি হয়। সে হিসাবে ওই পাঁচ চালানে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার কেজি বাল্ব আমদানি করা হয়। বাকি সাড়ে চার লাখ কেজি বাল্ব কোনো মান পরীক্ষা ছাড়াই ছাড় হয়েছে। একই অবস্থা আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য পলিয়েস্টার ব্লেন্ড স্যুটিং ও শার্টিং আমদানির ক্ষেত্রে। ফলে মানহীন পণ্য ছড়িয়ে পড়ছে বাজারে। সম্প্রতি বিএসটিআই পরিচালিত কয়েকটি অভিযানে বাজারে অনুমোদনহীন চীনা বাল্ব বিক্রির বিষয়টি ধরা পড়ে।
বিএসটিআই চট্টগ্রাম কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিএসটিআইয়ের অভিযানে সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার পাঁচ প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বাজারজাত করা চকচকে মোড়কের এনার্জি সেভিং বাল্বে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেই। চীন থেকে ২৩, ২৫, ২৬ ও ৩২ ওয়াটের এসব বাল্ব এনে ভুয়া উৎপাদক ও সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানের নামে এক-দুই বছরের গ্যারান্টি দিয়ে বাজারজাত করছে সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র। সম্প্রতি যেসব ব্র্যান্ডের পণ্য জব্দ করা হয়েছে তা হলো— দাইসি লাইটিং অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট কোম্পানির দাইসি ও হামের, সানপ্লাস করপোরেশনের সানপ্লাস, ঢাকার স্নো-ওয়াইট এন্টারপ্রাইজের ওসাকা, টাফ ও জেট লাইফ, পাওয়ারপ্যাক এনার্জি কোম্পানির পাওয়ারপ্যাক ও পারফেক্ট এবং চেমন ইলেকট্রিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির লিপার ব্র্যান্ড। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই বিএসটিআই অধ্যাদেশে মামলা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিইএমএমএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট ও এলিজা ইলেকট্রিক কোম্পানির স্বত্বাধিকারী মো. আলমগীর হোসেন জানান, ‘এনবিআরকে এর আগে আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে, আমদানি করা সিএফএল বাল্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া যেন বাজারে প্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে। বিশেষ করে চীন থেকে আমদানিকৃত এসব বাল্বের বেশির ভাগই অত্যন্ত নিম্নমানের। এছাড়া অবাধ প্রবেশের কারণে স্থানীয়ভাবে উৎপাদকরাও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’
বিশেষজ্ঞরা জানান, নিম্নমানের বাল্বে যে পারদ ব্যবহার হয় তা অত্যন্ত বিষাক্ত। এজন্য আমদানি করা বাল্ব বাজারজাতের আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা জরুরি। এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সরফরাজ খান চৌধুরী বলেন, ‘নিম্নমানের বাল্ব থেকে অতিবেগুনি রশ্মি বের হয়, যা চোখ ও শরীরের জন্য ক্ষতিকর। যারা ত্বকের সমস্যায় ভুগছেন, এ বাতির বিকিরণ তাদের সমস্যা দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। অতিমাত্রায় এ বিকিরণ থাকলে ত্বকের ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। এসব বাল্ব অকেজো হয়ে যাওয়ার পর যত্রতত্র ফেলে দেয়ায় সে পারদ মাটি, পানি, এমনকি বায়ুও দূষিত করে। তাই নিম্নমানের বাল্বের যথেচ্ছ ব্যবহার অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে।’
কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগের সভাপতি এএসএম নাজের হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, আমদানি করা পণ্যের গুণগত মান পরীক্ষা ছাড়া বাজারে প্রবেশ করায় ঠকছেন ভোক্তারা। অথচ প্রত্যেক ক্রেতারই মানসম্পন্ন পণ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও তদারককারী সংস্থার অবহেলায় তার প্রতিপালন হচ্ছে না।
আমদানি নীতি আদেশ ২০১২-১৫ অনুযায়ী, ৪৩টি পণ্য বন্দর থেকে ছাড়করণের আগে বিএসটিআইয়ের ল্যাব থেকে মান পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি পণ্য হলো— সিএফএল বাল্ব, পলিয়েস্টার ব্লেন্ড স্যুটিং ও পলিয়েস্টার ব্লেন্ড শার্টিং।
বিএসটিআইয়ের অন্য একটি অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এবং (সংশোধিত) আইন, ২০০৩ অনুযায়ী বাধ্যতামূলক সিএম লাইসেন্সের অন্তর্ভুক্ত পণ্য সিএম লাইসেন্স গ্রহণ ছাড়া বিক্রয়, বিতরণ, ও বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচার করা নিষিদ্ধ। নিয়ম অনুযায়ী এসব পণ্য বিএসটিআই ল্যাবে মান পরীক্ষা করে পণ্যসংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র শুল্ক কর্তৃপক্ষকে দাখিল করবে। বিএসটিআইয়ের রিপোর্টে ফলাফল ইতিবাচক হলে তখনই পণ্য ছাড়করণের অনুমতি মিলবে।
জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে গত ৩০ জুন চট্টগ্রাম শুল্ক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে বিএসটিআই। সংস্থাটির চট্টগ্রাম কার্যালয়ের প্রধান মো. শওকত ওসমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও বেশকিছু পণ্য বন্দর থেকে ছাড়করণের আগে বিএসটিআই থেকে গুণগত মান যাচাই করে সনদ নেয়া হচ্ছে না। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে— পলিয়েস্টার ব্লেন্ড স্যুটিং, পলিয়েস্টার ব্লেন্ড শার্টিং ও সিএফএল। পরীক্ষণবিহীনভাবে এসব পণ্যের শুল্কায়ন করায় স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ছাড়াও ভোক্তা সাধারণ গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি ভোক্তা সাধারণকে প্রতারণা থেকে রক্ষা করতে আমদানি করা এসব পণ্যের ক্ষেত্রে গুণগত মান নিশ্চিত করে প্রত্যয়নপত্র প্রাপ্তিসাপেক্ষে ছাড় দেয়ার জন্য শুল্ক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে শওকত ওসমান জানান, আমদানি নীতিমালা অনুযায়ী মান পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা থাকায় তিন ধরনের পণ্য বন্দর থেকে ছাড়করণের আগে বিএসটিআই কর্তৃক সনদ নিতে চট্টগ্রাম শুল্ক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে একাধিকবার চিঠি দেয়া হয়েছে তাদের। এসব পণ্য ক্রয়ে ক্রেতাদের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি থাকার বিষয়ে চিঠির মাধ্যমে অবগত করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, এসব পণ্যের মান পরীক্ষা করতে বিএসটিআই কর্তৃক প্রচুর সময়ক্ষেপণ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৫-২০ দিনও সময় ব্যয়ের নজির রয়েছে। এতে প্রতিদিন ৮-১০ হাজার টাকা ডেমারেজ গুনতে হয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে। ফলে তারা লোকসান গুনে বিএসটিআই থেকে পণ্যের মান পরীক্ষা করিয়ে আনতে আগ্রহী হয় না।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার আজিজুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, আমদানিকারকের অনীহা থাকলেও আইনের বাধ্যবাধকতা থাকায় এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। বন্দর থেকে ছাড়করণের আগে বিএসটিআই থেকে পণ্যের মান সনদ বা প্রত্যয়নপত্র নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।