ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন বাস্তবায়ন বিলম্বে বছরে আর্থিক ক্ষতি দশ হাজার কোটি টাকা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ অক্টোবর ২০১৪, ১০:০০ পূর্বাহ্ণ
অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক ::
দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনের কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০১২ সালে। কিন্তু দুই দফা মেয়াদ বাড়ানোর পরও প্রায় ৪০ শতাংশ কাজ এখনো বাকি। বাধ্য হয়ে তৃতীয় দফা মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে প্রকল্পের। আর এ বাস্তবায়ন বিলম্বে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। এর মধ্যে অর্ধেক ক্ষতিই ব্যবসায়ী তথা রফতানিকারকদের। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) প্রাক্কলনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গত বছর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের সময় প্রাক্কলনটি করা হয়। এতে বলা হয়, দুই দশক আগে সড়কপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে সময় লাগত ৪-৫ ঘণ্টা। তখন এ মহাসড়কে দৈনিক ১০ হাজার যানবাহন চলাচল করত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দৈনিক গড়ে ৫০ হাজার যানবাহন চলছে। এত অধিকসংখ্যক যানবাহন চলায় দুই লেনের এ মহাসড়কটিতে যানজট বাড়ছে। এছাড়া মহাসড়কের পাশে বাজারের কারণেও যানজট হচ্ছে। এতে ৫ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে ৮-১০ ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। কখনো আবার লাগছে আরো বেশি সময়। ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়ছেই।
সওজের তথ্যমতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটের কারণে আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনে বিলম্ব হচ্ছে। শিপমেন্ট ঠিক রাখতে বাধ্য হয়ে অনেক সময় আকাশপথে পণ্য পাঠাতে হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। আর যাতায়াতে সময় অপচয়ের কারণে যাত্রীদের ক্ষতি ১ হাজার কোটি টাকা। দুর্ঘটনা ও ভাঙাচোরা সড়কের কারণে যানবাহনের ক্ষতি ৫৭০ কোটি টাকা। এছাড়া যানজটে জ্বালানি অপচয় হয় ২ হাজার কোটি টাকার, পরিবেশগত ক্ষতি ১ হাজার কোটি, স্বাস্থ্যগত ক্ষতি ৩০০ কোটি ও অন্যান্য ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মোট ক্ষতি ৯ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, মহাসড়কটি অর্থনীতির লাইফলাইন হওয়ায় দ্রুত চার লেনে উন্নীত করা উচিত। তবে এখনো কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া যানবাহনের চাপ ক্রমে বাড়তে থাকায় চার লেন সম্পন্ন হলেও বেশি দিন এর সুবিধা পাওয়া যাবে না। এজন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। তখন আড়াই-তিন ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া যাবে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের কাজ ২০১২ সালের জুনে সম্পন্ন করার কথা ছিল। পরে তা বাড়িয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর ও সর্বশেষ ২০১৪ সালের ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। তবে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হয়েছে প্রায় ৫৭ শতাংশ। ডিসেম্বর নাগাদ সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হতে পারে। এ অবস্থায় প্রকল্পটির মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।
এদিকে বাস্তবায়ন বিলম্বে বাড়ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন নির্মাণ ব্যয়। এরই মধ্যে প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়েছে প্রায় ১ হাজার ২২ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ সর্বশেষ সংশোধন করা হয় প্রকল্পটি। সে সময় ব্যয় বাড়ানো হয় ৭৮০ কোটি ১২ লাখ টাকা। এতে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৯০ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এর আগে ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রকল্পটি সংশোধন করে ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৪১০ কোটি ১৭ লাখ টাকা, ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ২ হাজার ৩৮২ কোটি ১৭ লাখ ও ২০০৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুমোদনের সময় ২ হাজার ১৬৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। আর এ দফায় ব্যয় বাড়ানো হলে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ব্যয় প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দাঁড়াবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুর বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি পদ্মা সেতুর চেয়েও ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের গুরুত্ব বেশি। তাই দ্রুত এটি বাস্তবায়ন করা উচিত।
সওজের তথ্যমতে, ১৯২ কিলোমিটার প্রকল্পটির মধ্যে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার সম্পন্ন হয়েছে। তবে ৪৩ কিলোমিটারের অগ্রগতি খুবই কম। ২ ও ৫ নং প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত ওই অংশের ঠিকাদার চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ নং প্যাকেজের আওতায় কুটুম্বপুর থেকে কুমিল্লা বাইপাসের শুরু পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার অংশের কাজ হয়েছে ২০ শতাংশেরও কম। আর ৫ নং প্যাকেজের বাতিশা থেকে মহীপাল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটারের অগ্রগতি প্রায় ২২ শতাংশ।
এছাড়া প্রকল্পের আওতায় সেতু নির্মাণে ১ নং প্যাকেজ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। এর আওতায় ইলিয়টগঞ্জ সেতু ছাড়াও কুমিল্লা ও ফেনী রেল ক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ করা হবে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই অংশের ৪২ শতাংশ কাজ হয়েছে। ওই অংশের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে যৌথ বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান শিখা-পিবিএল জেভি।
এদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের কাজ পরিদর্শন করে। বাস্তবায়ন বিলম্বের জন্য কমিটির সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের পরিচালক ইবনে আলম হাসান বলেন, মূলত প্রথম দুই বছর প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সবচেয়ে বিলম্বিত হয়। এ সময় জমি অধিগ্রহণে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয়। এছাড়া পরামর্শক নিয়োগ এক বছর বিলম্বিত হওয়ায় কাজ বন্ধ ছিল। আর গত বছর রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রায় চার মাস প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। সব মিলিয়ে প্রকল্পটি সঠিক সময়ে সম্পন্ন হয়নি। তবে দ্রুত চার লেনের কাজ শেষ করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।