জালিয়াতির মাধ্যমে ইউনিসেফের অর্থ উত্তোলন ও আত্মসাৎ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ অক্টোবর ২০১৪, ৯:৫৩ পূর্বাহ্ণ
জনতা ব্যাংকের শেরাটন (বর্তমানে রূপসী বাংলা) শাখায় প্রকল্পটির ব্যাংক হিসাব থেকে বিভিন্ন ধরনের জাল কাগজপত্র ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সই নকল করে অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। ২০১২ সালে প্রকল্পটি শুরুর পর নিয়মিত একটি চক্র এ অর্থ উত্তোলন করেছে, যাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রকল্পের হিসাবরক্ষক শাহানাজ পারভীন ও প্রোগ্রামার অনুপ কুমার।
পূর্বদিক ডেস্ক ::
জালিয়াতির মাধ্যমে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) একটি প্রকল্পের বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে প্রকল্পের দুই কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বর্তমানে তারা কারাগারে।
সূত্র জানায়, জনতা ব্যাংকের শেরাটন (বর্তমানে রূপসী বাংলা) শাখায় প্রকল্পটির ব্যাংক হিসাব থেকে বিভিন্ন ধরনের জাল কাগজপত্র ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সই নকল করে অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। ২০১২ সালে প্রকল্পটি শুরুর পর নিয়মিত একটি চক্র এ অর্থ উত্তোলন করেছে, যাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রকল্পের হিসাবরক্ষক শাহানাজ পারভীন ও প্রোগ্রামার অনুপ কুমার।
বড় অঙ্কের অর্থ জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রকল্প পরিচালক আশরাফুন্নেছা বলেন, জাল কাগজপত্র তৈরি করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। অর্থের প্রকৃত পরিমাণ জানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হয়। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত দুজনকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বর্তমানে তারা জেলহাজতে। এর সঙ্গে আরো কেউ জড়িত কিনা, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
সূত্রমতে, দেশের দরিদ্র শিশু-কিশোরদের সামাজিক নিরাপত্তায় ২০১২ সালে ‘এনাবলিং এনভায়রনমেন্ট ফর চাইল্ড রাইটস (ইইসিআর)’ শীর্ষক প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। প্রায় ৩১৮ কোটি টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পে অনুদান হিসেবে ইউনিসেফ দিচ্ছে ৩১৫ কোটি টাকা। বাকি ৩ কোটি টাকা সরবরাহ করা হচ্ছে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। প্রকল্পটি তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রকল্পের অর্থের বড় একটি অংশ শিশুদের জন্য ব্যয় না করেই ব্যাংক থেকে উত্তোলন করা হয়েছে।
জানা যায়, গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় কোটি টাকার একটি চেক দিয়ে অর্থ উত্তোলনের চেষ্টা করা হলে জনতা ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখার কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। সই না মিললে প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাংক। এর পরই জালিয়াতির বিষয়টি বেরিয়ে আসে। গত দুই বছরের বেশি সময়ে জালিয়াত চক্রটি বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেছে, যা বর্তমানে জনতা ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প কর্মকর্তাদের অদক্ষতার কারণে জাল-জালিয়াতির ঘটনা বাড়ছে। নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থায় গাফিলতি এর অন্যতম কারণ। একদিকে অদক্ষতার কারণে প্রকল্পের অর্থছাড় হচ্ছে না, অন্যদিকে জালিয়াতির কারণে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের ভেতরে-বাইরে দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে। এরই অংশ হিসেবে ইউনিসেফের প্রকল্পে জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। জালিয়াতির পেছনে প্রকল্পে আর্থিক নিরাপত্তায় দুর্বলতা যেমন রয়েছে, একই সঙ্গে রয়েছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশও।
জালিয়াতি করে অর্থ উত্তোলনের ঘটনা প্রকাশের পর ইউনিসেফসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠি দিয়ে অবহিত করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তাতে বলা হয়, ইইসিআর প্রকল্পে স্বাক্ষর নকল করে অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের একশ্রেণীর কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে তারা দোষও স্বীকার করেছেন। এখন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় অর্থ উদ্ধারে চেষ্টা করছে।
চিঠি পাওয়ার পরই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) জাতিসংঘ উইং থেকে দাতা সংস্থা ইউনিসেফের আবাসিক প্রতিনিধির কাছে চিঠি দিয়ে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, সুবিধাবঞ্চিত ও অবহেলিত শিশু-কিশোরদের ভাগ্যোন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ হিসেবে বৈদেশিক সহায়তা জালিয়াতির ঘটনায় ইআরডি উদ্বিগ্ন।
এদিকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি জানিয়েছে ইআরডি। তাতে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈদেশিক অনুদান কমে আসছে। যেটুকু আসছে, তার দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রকল্পটির সুফলভোগী হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও কিশোর। কিন্তু আর্থিক জালিয়াতি সে উদ্দেশ্য ব্যাহত করবে। একই সঙ্গে দাতা সংস্থাগুলোর কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
ইআরডির যুগ্ম সচিব মো. শামসুল বলেন, ‘জালিয়াতি করে অর্থ উত্তোলনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছি। যাতে ভবিষ্যতে একই ধরনের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য প্রকল্প পরিচালককেও অনুরোধ করা হয়েছে। আমাদের পক্ষে যতটুকু করণীয়, সবটুকুই করেছি। ইআরডির পক্ষ থেকে ইউনিসেফকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে ইউনিসেফের ঢাকা কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে তাত্ক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তারা।