ভারতের তুলনায় ইউনিটে দ্বিগুণ খরচ হবে রামপালে!
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৯:৩৯ পূর্বাহ্ণ
আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভারত ব্যয় করে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩-৪ টাকা। অথচ বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ব্যবস্থাপনায় বাগেরহাটের রামপালে যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র গড়ে উঠছে, সেখানে প্রতি ইউনিটের আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ টাকা।
পূর্বদিক ডেস্ক ::
সরকারি-বেসরকারি দুই খাতেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে ভারত। তেল, গ্যাস, পানি, পরমাণু, সৌর ও অন্যান্য উৎসের তুলনায় কয়লায় খরচ খুবই কম পড়ে বলে দেশটির মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের দুই-তৃতীয়াংশই কয়লাভিত্তিক। আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুৎ উৎপাদনে তারা ব্যয় করে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩-৪ টাকা। ছত্তিশগড় ও মহারাষ্ট্র রাজ্যের দুটি বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র ঘুরে এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। অথচ বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ব্যবস্থাপনায় বাগেরহাটের রামপালে যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র গড়ে উঠছে, সেখানে প্রতি ইউনিটের আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে ভারতের। কয়লা পরিবহনে রেল যোগাযোগ ব্যবহার করায় ব্যয় কমিয়ে আনতে পারে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। তাছাড়া একই জায়গায় দুই-তিন হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করায় জমিসংস্থান ও বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যায়। এসব সুবিধা কাজে লাগিয়ে ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখে দেশটি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) আমন্ত্রণে ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের সিপাত ২ হাজার ৯৮০ মেগাওয়াট ও মহারাষ্ট্র রাজ্যে আদানি গ্রুপের তিরোদা ৩ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দল। বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির কর্মকর্তারা আয়-ব্যয়ের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। সিপাত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি)। বাংলাদেশের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পিডিবির সঙ্গে যৌথ কোম্পানি গঠন করেছে এনটিপিসি। আর তিরোদার কেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে আদানি গ্রুপ। ভারতের প্রভাবশালী এ গ্রুপও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
সরেজমিনে কেন্দ্র দুটি ঘুরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। সিপাত ও তিরোদা দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গেই রেল যোগাযোগ রয়েছে। তাই সহজেই কয়লা পরিবহন করা যায়। বাংলাদেশে নির্মাণাধীন কোনো কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গেই রেল যোগাযোগ নেই। সমুদ্র উপকূল থেকেও রামপালের অবস্থান দূরে থাকায় লাইটারেজ জাহাজ ব্যবহার করতে হবে কয়লা পরিবহনে। এটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় বাড়িয়ে তুলবে।
কানাডার ন্যাশনাল এনার্জি বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত একটি গবেষণায় বলা হয়, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র অবশ্যই কয়লাখনির কাছে হতে হবে। তা না হলে এটি হতে হবে গভীর সমুদ্রবন্দরের কাছে কিংবা রেললাইনের পাশে। তিনটির কোনোটির বিচারেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য সুন্দরবনসংলগ্ন রামপাল জুতসই এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রশ্নও রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সিপাত পাওয়ার প্লান্টের নির্বাহী পরিচালক ভিবি ফাদনাভিস বলেন, ‘কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের কোনো ক্ষতি করবে না, এটি একটি অবান্তর কথা। তেল, গ্যাস ও কয়লা যা-ই পোড়ানো হোক না কেন কার্বন তৈরি হবে। তাতে বাতাসে উত্তাপ ছড়াবেই। কিন্তু এসব ক্ষতি পরিবেশের জন্য গ্রহণযোগ্য মাত্রায় আনা সম্ভব হয়েছে আমাদের কেন্দ্রে। দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহারে এটা যে কোনো কেন্দ্রের ক্ষেত্রেই সম্ভব।’
তিরোদা বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্টেশন হেড চৈতন্য প্রসাদ সাহা বলেন, ‘সামগ্রিক ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমরা সে কাজ ভালোভাবে করছি। মহারাষ্ট্রের পরিবেশ অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণও রয়েছে আমাদের ওপর।’
ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশেও বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমাধান হতে পারে জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার।
ভারতের অধিকাংশ বিদ্যুৎ আসে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে। দেশী ও আমদানিকৃত বিভিন্ন কয়লা ব্যবহার হচ্ছে এসব কেন্দ্রে। ভারতের বর্তমান উৎপাদনক্ষমতা ২ লাখ ৫৩ হাজার ৩৮৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে কয়লাভিত্তিক উৎপাদন ১ লাখ ৫২ হাজার ৩১০ মেগাওয়াট। অন্যদিকে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২৫০ মেগাওয়াটে আটকে আছে বাংলাদেশ। সেখানেও নানা জটিলতায় আবদ্ধ। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইএসপি বিকল থাকা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে; যে কারণে চিমনি দিয়ে সবসময় ছাই উড়ছে বাতাসে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ গ্যাসনির্ভর হয়ে আছে। অথচ ভারতে গ্যাস দিয়ে উৎপাদন করা হচ্ছে মোট উৎপাদনের মাত্র ৯ শতাংশ। জল, পরমাণু, সৌর ও অন্যান্য উৎস থেকে আসছে বাকি বিদ্যুৎ। বাকি পুরোটাই কয়লায় উত্পন্ন হয়। জ্বালানির বহুমুখীকরণ ব্যবস্থা সার্থক হওয়ায় এমনটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন সিপাত বিদ্যুৎকেন্দ্রের এজিএম এস দেবাসি।
ভারতীয় কর্মকর্তাদের মতে, পরিবেশদূষণ রোধ বা বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবস্থাপনায় নজরদারি ও সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় সরকারের কড়া নজরদারি রয়েছে। একাধিক নীতিমালা ও বিধি-বিধানের মাধ্যমে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। হেরফের হলে উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ারও নজির আছে। বাংলাদেশকেও তাই করতে হবে।
এদিকে বাংলাদেশের একমাত্র বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না ভারতীয় কেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে। বড়পুকুরিয়ায় দৈনিক ছাই উত্পন্ন হয় ২৪০ টন আর ভারতের সিপাত বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপন্ন হয় ৮৫ হাজার টন। ১১৬টি হপারের মাধ্যমে ছাই ইয়ার্ডে চলে যাচ্ছে। সেখান থেকে ৩০ শতাংশ সিমেন্ট শিল্পে আর ৭০ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে মাটি ভরাটের কাজে। অথচ বড়পুকুরিয়ার সামান্য ছাই নিয়েই মহাবিপাকে পিডিবি। ছাই বাতাসে ও বৃষ্টির পানিতে ছড়িয়ে স্থানীয় তিলাই নদীর পানিকে দূষিত করে ফেলেছে। ওই নদীর পানি ব্যবহার করতে পারছে না স্থানীয়রা। এমনকি মাছও বাঁচাতে পারছে না।