মশা মারতে আসছে কৃত্রিম উপগ্রহ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৮:০৯ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
হ্যাঁ, সার্চলাইট নয়, স্যাটেলাইট, মানে কৃত্রিম উপগ্রহ৷ শুধু তত্ত্ব নয়, ব্যাপারটা হাতেনাতে পরীক্ষা করে দেখছেন জার্মান বিজ্ঞানীরা, আফ্রিকার বুরকিনা ফাসোতে৷ স্যাটেলাইট দেখাবে এঁদো পুকুর, মশা মারবে ব্যাকটেরিয়া৷
আমরা শুনি কখনো এইডস, কখনো এবোলা মহামারী, কিন্তু বস্তুত যে রোগটি বছরের পর বছর আফ্রিকা মহাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণ নিচ্ছে, তার নাম হলো ম্যালেরিয়া৷ প্রতি বছর সারা বিশ্বে দশ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ায় ভুগে প্রাণ হারায়, তাদের ৯০ শতাংশই আফ্রিকায়৷
ওদিকে জার্মানির রাইন নদ এলাকায় চিরকালই মশার প্রাদুর্ভাব, যদিও তারা ম্যালেরিয়া মশা নয় । তবুও তারা কামড়ায়, জ্বালাতন করে৷ তাই গত ৪০ বছর ধরে রাইন নদের দু’পাড়ে পোকামাকড়, মশামাছি কমানোর অভিযান চলেছে৷ মশা মারার পদ্ধতি হলো: ব্যাসিলাস থুরিঙ্গিয়েনসিস ইস্রায়েলেনসিস বা বিটিআই ব্যাকটেরিয়া পচা জলে ছেড়ে দেওয়া; তা-তে নাকি মশার শূককীটদের ৯৮ শতাংশ বিনষ্ট হয়, অথচ অন্যান্য পোকামাকড়, প্রাণী কিংবা উদ্ভিদ অক্ষত থাকে৷
মশার এক কামড়েও হতে পারে মৃত্যু
আফ্রিকার সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণীর নাম এনোফিলিস মশা৷ লম্বায় ছয় মিলিমিটার এই মশা ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী৷ প্রতি বছর সারা বিশ্বের প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ এ রোগে মারা যায়৷
মহাকাশ থেকে মশা
বিটিআই ব্যাকটেরিয়া যদি রাইন নদের তীরে মশার শূককীট মারতে পারে, তাহলে তারা আফ্রিকাতেই বা কাজে লাগবে না কেন? ইথিওপিয়া ও কেনিয়ার মতো দেশে ইতিমধ্যেই মশার বংশবৃদ্ধি রোখার জন্য বিটিআই ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হচ্ছে৷ কিন্তু হাইডেলব্যার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এবার যে বিশেষ প্রকল্পটি নিয়ে বুরকিনা ফাসোতে ফিল্ড এক্সপেরিমেন্টে নেমেছেন, তা শুধু ফিল্ড অর্থাৎ ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, তার সূচনা আকাশে, অর্থাৎ কিনা মহাকাশে: কেননা কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাঠানো ‘ইমেজ’ বিশ্লেষণ করে দেখা হয়, মাটির পৃথিবীতে ঠিক কোথায় জলাশয়, তার জলই বা কেমন আর সে জলে মশার ছানোপোনা গজানোর সম্ভাবনাই বা কতটা৷ জায়গাটা হলো পশ্চিম আফ্রিকার বুরকিনা ফাসোর একটি এলাকা; এলাকার ১২৭টি গ্রামে প্রায় দেড় লাখ মানুষের বাস৷
বুঝে-সুঝো বিটিআই
হাইডেলব্যার্গের বিজ্ঞানীদের পদ্ধতির অভিনবত্ব উপলব্ধি করার জন্য প্রথমে বলে নেওয়া দরকার যে, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ বলতে বিশেষ কীটনাশকযুক্ত মশারি ছাড়া আর বিশেষ কোনো পন্থা নেই৷ আবার সে পন্থাতেও শুধু রাতেই সুরক্ষা পাওয়া যায়৷ তাই নরব্যার্ট বেকার-এর মতো বিজ্ঞানীরা স্থির করেছেন, তাঁরা মশা মারবেন, মশারা যেখানে জন্ম নেয়, সেই এঁদো জলে বা বদ্ধ জলাশয়ে৷ তাদের ফিল্ড এক্সপেরিমেন্টের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু এলাকার মানুষদের ম্যালেরিয়ার হাত থেকে রক্ষা করা৷ তাই এলাকার গ্রামগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে: এক-তৃতীয়াংশ গ্রামে আগের মতোই শুধু মশারি ব্যবহার করা হচ্ছে; এক-তৃতীয়াংশ গ্রামে যাবতীয় জলাশয়ে বিটিআই ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগ করা হচ্ছে; বাকি এক-তৃতীয়াংশ গ্রামে শুধু সেই সব জলাশয়ে বিটিআই ছাড়া হচ্ছে, যেখানে বাস্তবিক মশার শূককীট খুঁজে পাওয়া গেছে৷ এই তৃতীয় পদ্ধতিটি নতুন এবং এর উদ্দেশ্য হলো, বুরকিনা ফাসোর মতো দরিদ্র দেশগুলি যেন তাদের অর্থ, জনবল ও সাজসরঞ্জাম ঠিকভাবে নিয়োগ করে৷
মশাদের পছন্দ-অপছন্দ
ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগ করে মশক বিনাশের এই সর্বাধুনিক পদ্ধতির নাম হলো ‘সিলেক্টিভ স্প্রেয়িং’: পুকুর বেছে ব্যাকটেরিয়া ছাড়া৷ স্যাটেলাইটের ছবি থেকেই নাকি বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, জলের উপরিভাগ কেমন এবং মশারা সেখানে ডিম পাড়ে কিনা৷ মশাদেরও নাকি পানির ব্যাপারে পছন্দ-অপছন্দ আছে৷ যে সব শূককীট থেকে পরে মশা তৈরি হয়, তারা নাকি গুল্ম-লতাপাতা যুক্ত পরিষ্কার জল পছন্দ করে৷ জল ঘোলা না পরিষ্কার, তার রং কিরকম, তা-তে কি পরিমাণ পুষ্টিকর পদার্থ আছে – এ সবই নাকি মশাদের কোনো বিশেষ জলাশয়ের প্রতি আকৃষ্ট করে অথবা করে না৷
সব কিছু বিচার করে দেখা হয়, সর্বাগ্রে কোথায়, কোন কোন জলাশয়ে বিটিআই ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগ করা উচিত৷ প্রতি দশ দিন অন্তর ব্যাকটেরিয়া স্প্রে করতে হয়৷ আশেপাশের গ্রামগুলিতে শিশুদের মধ্যে কী পরিমাণ ম্যালেরিয়ার ঘটনা ঘটছে, তারও পরিসংখ্যান রাখা হয় – কেননা গোটা প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো: ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কি কমছে, এই মারণব্যাধিতে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা কি কমছে?
ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সাফল্য
ম্যালেরিয়া পৃথিবীজুড়ে এখনো একটি ঘাতক রোগ হিসেবে পরিচিত৷ বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ার কারণে প্রাণ হারান৷ জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, ২০১০ সালে ২১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল, এর মধ্যে ৬ লাখ ৬০ হাজার মৃত্যুবরণ করে৷ মৃতের এই সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে অবশ্য তথ্যের ভিন্নতা রয়েছে।
বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দশ বছর আগে সারা দেশে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ আক্রান্ত হত ম্যালেরিয়ায় এবং মারা যেত প্রায় পাঁচশ৷ তবে ২০০৭ সাল থেকে ম্যালেরিয়া শনাক্ত ও চিকিৎসা সুবিধা বাড়ায় এই রোগে মৃত্যুহার যেমন কমেছে, তেমনি রোগের বিস্তারও নিয়ন্ত্রণ করা গেছে।
সমন্বিত উদ্যোগে সাফল্য
মূলত সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে৷ বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি বেশি৷ তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় ও বনাঞ্চল সহ সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ এখনো পুরোপুরি দূর করা যায়নি।
কীটনাশকযুক্ত মশারি
ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ কমাতে এখন ভালো ভূমিকা রাখছে কীটনাশকযুক্ত মশারি৷ আগে এসব মশারি ধোয়া নিয়ে যে জটিলতা ছিল তাও দূর হয়েছে৷ ‘লাইফ-নেট’ নামক এক ধরনের মশারি তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা, যার কৃত্রিম তন্তুতেই ঢোকানো থাকে কীটনাশক৷ এই মশারি ধোয়াও যায় নিশ্চিন্তে৷ আর মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে সেরা উপায় আজও মশারি৷
ম্যালেরিয়ার টিকা
তবে ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচার সবচেয়ে সহজ পন্থা হলো টিকা তৈরি করা৷ সুদীর্ঘ ত্রিশ বছর গবেষণার পর সম্প্রতি একটি টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মানুষের শরীরে রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করতে সক্ষম৷ ব্রিটিশ ওষুধ কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বা জিএসকে-র আশা, তাদের এই টিকা ২০১৫ সালের মধ্যে সর্বত্র ব্যবহৃত হবে৷
নতুন আশঙ্কা
ম্যালেরিয়ার টিকা আবিষ্কার যেমন আশার কথা শোনাচ্ছে তেমনি নতুন ধরনের ম্যালেরিয়ার খবর জাগাচ্ছে শঙ্কা৷ ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকা সম্প্রতি এক রিপোর্টে নতুন ধরনের ম্যালেরিয়া জীবাণুর কথা জানিয়েছে৷ জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনের বরাতে পত্রিকাটি জানায়, ভৌগলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন ধরনের ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে আছে।