পাটের সাফল্য ধরে রাখতে পারছে না সরকার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৭:৫৩ পূর্বাহ্ণ
অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক ::
মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার ছিল সরকারি পাটকলগুলো সচল রেখে এ শিল্পকে লাভজনক করা। কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করায় সফলতা আসতে শুরু করে ক্ষমতা গ্রহণের পরের অর্থবছর থেকেই। বাড়তে থাকে পাটের আবাদ, উত্পাদন এবং কাঁচাপাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি। লোকসানি প্রতিষ্ঠান থেকে মুনাফার ধারায় ফেরে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)। কিন্তু গত দুই অর্থবছরে স্বর্ণসুতাখ্যাত পাটের আবাদ, উত্পাদন ও রফতানি কমায় পুরনো চেহারায় ফিরে আসছে পাট খাত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, বর্তমান সরকার গত মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের সময় অর্থাত্ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১০ লাখ ৩৯ হাজার একরে পাটের উত্পাদন ছিল ৮ লাখ ৪২ হাজার টন। পরের অর্থবছরে ১০ লাখ ২৯ হাজার একর জমি থেকে উত্পাদন হয় ৯ লাখ ১৬ হাজার টন। ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৭ লাখ ৫১ হাজার একর জমিতে উত্পাদন হয় ১৫ লাখ ১১ হাজার টন পাট। পরের অর্থবছরে ১৮ লাখ ৭৮ হাজার একর থেকে পাওয়া যায় ১৪ লাখ ৪১ হাজার টন পাট। এর পর ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে আবাদ ও উত্পাদন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৬ লাখ ৮৩ হাজার একর জমিতে ১৩ লাখ ৭০ হাজার এবং বিদায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা আরো কমে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৪৫ হাজার একর জমিতে ১৩ লাখ ৩৮ হাজার টন।
জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিজেএমসি লোকসানের ভারে এখন ন্যুব্জ। কয়েক দশক ধরেই লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠানটি ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৯ কোটি ৫২ লাখ এবং পরের অর্থবছরে ৭৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা লাভ করে। কিন্তু ২০১২-১৩ অর্থবছরে লোকসান হয় ৩৮৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরে ৪৫২ কোটি ২৩ লাখ টাকায় ঠেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ন্যায্য দাম না পাওয়া এবং জাগ দেয়ার পানির অভাব ও প্রতিবন্ধকতা পাট আবাদে নিরুত্সাহিত করছে কৃষকদের। এজন্য পানির বিকল্প হিসেবে পাট পচানোর রিবন মেশিন সহজলভ্য না করাকে দায়ী করছেন তারা।
উত্পাদিত পাটের সিংহভাগই ব্যবহার হয় পাটকলে। সরকারি-বেসরকারি পাটকলগুলোয় পাটজাত পণ্য তৈরিতে ব্যবহার হয় ৭ থেকে ১০ লাখ ও কাঁচাপাট হিসেবে রফতানি হয় তিন-চার লাখ টন পাট। এছাড়া হস্তশিল্পে ৫০ হাজার ও বাকি দু-তিন লাখ টন পাট কৃষক এবং ব্যবসায়ী পর্যায়ে মজুদ থাকে। পাটজাত পণ্য রফতানির সবচেয়ে বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া, তুরস্ক ও ইরানসহ কয়েকটি দেশ। আরব দেশগুলোয় কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক সংকট দেশের পাট শিল্পের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রফতানি কমায় বিপাকে পড়েছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি জীবিকা হারানোর ঝুঁকিতে আছে শিল্পসংশ্লিষ্ট কয়েক লাখ মানুষ। পাটচাষীর ওপরও পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব।
এ বিষয়ে জনতা জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) সভাপতি নাজমুল হক বলেন, ‘আমরা মৃত্যুসজ্জায় আছি। খাতটির নাজুক অবস্থার প্রভাব অন্য খাতেও পড়তে শুরু করেছে। সামনের দিনে এর বিরূপ প্রভাব সামষ্টিক অর্থনীতিতেও পড়বে।’
পাটের আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনতে শুধু স্বল্প সুদে ঋণ কিংবা ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হলেই হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, এ খাতের উদ্যোক্তাদের বকেয়া ভর্তুকি পরিশোধ, নতুন বাজার অনুসন্ধান ও বিকল্প পণ্য উত্পাদনে পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্য সংকটে ডুবতে বসেছে পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি। ভারতে টাকার বিপরীতে রুপির মূল্য কমে যাওয়া, পাটজাত পণ্য রফতানিতে উৎসে করারোপসহ নানা কারণও ধসের জন্য দায়ী। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৭৮ কোটি ৮ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি হয়। পরের অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। কিন্তু ২০১০-১১ অর্থবছরে তা কমে হয় ৯৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। পরের অর্থবছরে তা বেড়ে ১০৩ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। গেল অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৮২ কোটি সাড়ে ৪ লাখ ডলারে।
এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক বলেন, পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও বাহ্যিক কারণে কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। তবে পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। পাট শিল্পের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে কাঁচাপাট রফতানিতেও। বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএ) এবং আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডব্লিউজিসির তথ্যমতে, দেশের কাঁচাপাটের সিংহভাগই রফতানি হয় ভারত, পাকিস্তান ও চীনে। এছাড়া ব্রাজিল, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও আইভরি কোস্টে পণ্যটি রফতানি হয়। গেল অর্থবছরে কাঁচাপাট রফতানি কমেছে ৪৫ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে পণ্যটির রফতানি ছিল ২২ কোটি ২৯ লাখ ডলার। কিন্তু গত অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২ কোটি ৬৪ লাখ ডলারে। কাঁচাপাট রফতানি কমার পেছনে দেশের প্রধান বাজার ভারতে টাকার বিপরীতে রুপির মূল্য কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বিভিন্ন করারোপের মাধ্যমেও নিরুত্সাহিত করা হচ্ছে খাতটিকে।
এ বিষয়ে বিজেএ সচিব আবদুল কাইয়ুম জানান, অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে উেস করারোপ উদ্যোক্তাদের নিরুত্সাহিত করছে। তার পরও নতুন বাজারে প্রবেশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এ খাতে রফতানিকারকদের উত্সাহিত করতে করারোপ প্রত্যাহার ছাড়াও অন্য সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহার বাড়ানোর সুপারিশও করেন খাত সংশ্লিষ্ট অনেকে। দেশের বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে পাট এবং পাটজাত পণ্যের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এজন্য ‘পণ্যের মোড়কীকরণে পাট পণ্যের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ দ্রুত বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন তারা।
বিভিন্ন পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে জানিয়ে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী বলেন, রফতানিতে নগদ প্রণোদনা, বাজার বহুমুখীকরণসহ দেশের অভ্যন্তরে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এছাড়া জাত উন্নয়ন ও পাটের বিকল্প ব্যবহারে গবেষণা জোরদার করা হয়েছে। বিজেএমসির উন্নয়নে বাজারজাতকরণ ও উত্পাদন কৌশলে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আশা করা যায়, এগুলোর বাস্তবায়ন হলে পাট খাত আবার সোনালি দিন ফিরে পাবে।