ইন্টারনেট এখনো সর্বস্তরে সহজ লভ্য নয়
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ
ডটকম। ব্যবসা-বাণিজ্য, সেবা ও ব্যক্তিগত আদান-প্রদানের নতুন জগত্। সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে সক্রিয় প্লাটফর্ম। একদিকে চিঠি আদান-প্রদান, নিজের ফ্যান্টাসি, অবদমন, ভালোলাগা-মন্দলাগার বহিঃপ্রকাশ অকপটে। অন্যদিকে পছন্দের জিনিসের বিকিকিনি অনলাইন শপিংয়ে। ইয়াহু, গুগল, অ্যামাজন, ফেসবুক বেশ শক্তভাবেই নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। সম্প্রতি চীনের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবা যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) রেকর্ড পরিমাণ ২ হাজার ১৮০ কোটি ডলার তহবিল সংগ্রহ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
দেশে ইন্টারনেট সেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সরকার গত কয়েক বছরে ব্যান্ডউইডথের মূল্য কমিয়েছে। চালু হয়েছে ডাটাভিত্তিক থ্রিজিপ্রযুক্তি। এর পরও ইন্টারনেট সেবার নিয়মিত গ্রাহকের সিংহভাগই রাজধানী ও বড় শহরকেন্দ্রিক। এখনো মূলত অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সেবা হিসেবেই পরিগণিত হচ্ছে ইন্টারনেট। উচ্চমূল্য, ইন্টারনেটভিত্তিক প্রয়োজনীয় সেবা ও সচেতনতার অভাবই এজন্য দায়ী বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
শীর্ষ সেলফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১১ শতাংশ সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। যদিও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির হিসাবে মোট জনগোষ্ঠীর ২৫ শতাংশের ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সক্রিয় গ্রাহক ১৫ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৫, থাইল্যান্ডে ৩২ ও মালয়েশিয়ায় ৩৭ শতাংশ। দেশে সেলফোন অপারেটরদের আয়ের মাত্র ৪ শতাংশ আসছে ডাটাভিত্তিক সেবা থেকে। প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানেও একই অবস্থা। তবে থাইল্যান্ডে ডাটাভিত্তিক সেবা থেকে ১৭ ও মালয়েশিয়ায় ২২ শতাংশ আয় করছে সেলফোন অপারেটররা।
এদিকে গ্রামীণফোন মনে করে, দেশের গ্রাহকদের ৮০ শতাংশই ইন্টারনেট সম্পর্কে সচেতন নয়। ইন্টারনেটের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করছে এটি। কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিবেক সুদ বেশ জোরেশোরেই সম্প্রতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলছেন, সচেতনতার অভাবই এর সম্প্রসারণে প্রধান বাধা। এজন্য প্রয়োজন স্থানীয় কনটেন্ট তৈরিতে উত্সাহ দেয়া। এ বিষয়ে গ্রামীণফোন বড় ভূমিকা রাখার চেষ্টাও করছে।
গ্রামীণফোনের জরিপ অনুযায়ী, সেলফোন অপারেটরদের ইন্টারনেট সেবার নিয়মিত ব্যবহারকারী ৮ শতাংশ। সেবাটির অনিয়মিত ব্যবহারকারী রয়েছে ৯ শতাংশ। এর বাইরে মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ ইন্টারনেটের ব্যবহার সম্পর্কেই জানে না। আর ৩ শতাংশের এ-সম্পর্কিত জ্ঞান থাকলেও তা ব্যবহার করে না। ডাটাভিত্তিক সেবার নিয়মিত গ্রাহকের ৮০ শতাংশই মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে। এছাড়া ২১ শতাংশ ইউটিউব, ১৪ শতাংশ উইকিপিডিয়া, ১২ শতাংশ সংবাদ মাধ্যম এবং ১১ শতাংশ ব্লগ ব্যবহার করে।
আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ংয়ের এক জরিপও বলছে, ডাটাভিত্তিক সেবা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে গ্রাহকের মধ্যে। বিশ্বে সেলফোনের ৪৪ শতাংশ গ্রাহকের ডাটাভিত্তিক সেবা সম্পর্কে ধারণার অভাব রয়েছে। অপারেটরদের এ-সম্পর্কিত প্রচারণার অভাবও রয়েছে বলে মনে করেন প্রতি ১০ জনের তিনজন গ্রাহক।
এ প্রসঙ্গে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সাবেক সহসভাপতি সুমন আহমেদ সাবির বলেন, সেলফোন অপারেটরদের মাধ্যমে এরই মধ্যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছেছে। তবে প্রান্তিক মানুষের কাছে সেবাটির মূল্য এখনো আয়ত্তের বাইরে। এছাড়া ইন্টারনেটভিত্তিক প্রয়োজনীয় সেবার অভাবও এক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। সরকারি বিভিন্ন সেবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজলভ্য হলে আগ্রহী হয়ে উঠবে সাধারণ মানুষ।
বাজার গবেষকরা বলছেন, ডাটাভিত্তিক সেবার ডিভাইসের দাম এখনো তুলনামূলক ব্যয়বহুল। ডিভাইসের দাম আগের তুলনায় কমলেও তা প্রান্তিক মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় আসেনি। ফলে এসব মানুষের কাছে ইন্টারনেট সেবা সহজলভ্য নয়। আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডাটাভিত্তিক সেবা গ্রহণের জন্য প্রযুক্তিসহায়ক ডিভাইস অত্যাবশ্যক। থ্রিজিপ্রযুক্তি সহায়ক ডিভাইস সহজলভ্য না হলে এ সেবার প্রসার স্বাভাবিকভাবেই বাধাগ্রস্ত হবে। বিশ্বে প্রতি তিনজন সেলফোন গ্রাহকের একজন ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ইন্সট্যান্ট মেসেজিং ও সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে স্মার্টফোন রয়েছে এমন গ্রাহকের ব্যবহারের পরিমাণ অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ। সেলফোনে ভিডিও, অন স্টোর সেবা ও ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (ভিওআইপি) সেবাগ্রহীতার সংখ্যা প্রতি পাঁচজনে একজন।
বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমপিআইএ) সাধারণ সম্পাদক ও সিম্ফনি মোবাইলসের পরিচালক রেজওয়ানুল হক বলেন, এ দেশে ক্রেতারা ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সর্বোচ্চ সুবিধাসম্পন্ন হ্যান্ডসেট কিনতে আগ্রহী। থ্রিজির বিস্তৃতির জন্য অপারেটরদের প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি সুলভে স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা গুরুত্বপূর্ণ। গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ডিভাইস সহজলভ্য না হলে বাধাগ্রস্ত হবে ইন্টারনেটের কাঙ্ক্ষিত বিস্তার।
বিটিআরসির প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, জুলাই পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেটের সংযোগ ৩ কোটি ৯৩ লাখ ৫৩ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে সিংহভাগই সেলফোন অপারেটরদের ডাটাভিত্তিক সেবার গ্রাহক। ছয় সেলফোন অপারেটরের ইন্টারনেট সেবার গ্রাহক ৩ কোটি ৭৮ লাখ ৪৬ হাজার। এছাড়া আইএসপি ও পিএসটিএনের ইন্টারনেট সেবায় ১২ লাখ ৩১ হাজার এবং ওয়াইম্যাক্স অপারেটরদের ২ লাখ ৭৬ হাজার গ্রাহক রয়েছে। তবে সংযোগ সুবিধার আওতায় গ্রাহকদের একটা বড় অংশ সক্রিয় ডাটা ব্যবহারকারী নয়। সেবাদানকারীদের মতে, মোট সংযোগের অন্তত ৫০ শতাংশ অধিকাংশ সময় অলস পড়ে থাকে বা তারা সক্রিয় ব্যবহারকারী নয়; তাই প্রকৃত ডাটা ব্যবহারকারী ১ কোটি ৮০ লাখ বা সর্বোচ্চ ২ কোটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
তবে থ্রিজিপ্রযুক্তির কল্যাণে ইন্টারনেট সম্প্রসারণের ধীরগতি অনেকটা কেটে যাবে বলে মনে করে মোবাইল অপারেটরদের অ্যাসোসিয়েশন অ্যামটব। গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত নিলামের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে থ্রিজির তরঙ্গ বরাদ্দ ও লাইসেন্স পায় চার অপারেটর— গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল। একই বছরের ৭ অক্টোবর গ্রামীণফোন, ২১ অক্টোবর বাংলালিংক, ৩০ অক্টোবর রবি ও ৭ নভেম্বর এয়ারটেল বাণিজ্যিকভাবে এ সেবা চালু করে। আর রাষ্ট্রায়ত্ত সেলফোন অপারেটর টেলিটক ২০১২ সালের অক্টোবরে পরীক্ষামূলক এ সেবা চালুর অনুমোদন পায়। বর্তমানে পাঁচ অপারেটরের থ্রিজিসেবার গ্রাহকসংখ্যা ৫০ লাখের বেশি। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের প্রায় ২০ লাখ, বাংলালিংকের সাড়ে ৪ লাখ, রবির ১৩ লাখ, এয়ারটেলের সাড়ে ৫ লাখ ও টেলিটকের ১০ লাখ থ্রিজি গ্রাহক রয়েছে।
অ্যামটবের মহাসচিব টিআইএম নুরুল কবির বলেন, অপারেটররা বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়েই থ্রিজি লাইসেন্স নিয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থেকে এ খাতে বিনিয়োগ করছে তারা। এরই মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে তাদের সেবা চালুও হয়েছে। দেশব্যাপী এ সেবা ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা থেকে কাজ করছে অপারেটররা। স্বল্পমূল্যের নতুন নতুন প্যাকেজের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের কাছে সেবাটি জনপ্রিয় করে তোলার প্রক্রিয়া চলছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।