শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে লভ্যাংশ দিতে আনাগ্রহ ব্যবসায়ীদের
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৭:৫১ পূর্বাহ্ণ
সর্বশেষ সংশোধিত আইনে ৫ শতাংশের ১০ শতাংশ সরকারের তহবিলে জমা দেয়ার বিষয়টি আসার পর সরকার এ আইন প্রতিপালনে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে সরকারের উচিত হবে লভ্যাংশের ৫ শতাংশ কর্মীদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়া হচ্ছে কিনা তা নজরদারি করা। আর সরকারি অডিট প্রতিষ্ঠান দ্বারা এ ধারা প্রতিপালনে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো। কারণ ৫ শতাংশ ভাগ করে নেয়ার আইন প্রতিপালন হলে স্বাভাবিকভাবেই সরকারের তহবিলে অর্থ জমা পড়তে শুরু করবে। বাংলাদেশে লাভজনক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনুযায়ী এক বছরে ৬৬ কোটি টাকা খুবই কম।
অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক ::
শ্রমিকের কল্যাণে তহবিল গঠন করেছে সরকার। আইন অনুযায়ী দেশে সক্রিয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে লাভ হলে তার ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। আবার এ অর্থের একটা নির্দিষ্ট অংশ সরকারি বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে জমা দিতে হবে। তবে লভ্যাংশ জমা দেয়ার বিষয়ে এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহ ফুটে উঠেছে।
জানা গেছে, অনেক প্রতিষ্ঠানপ্রধান শ্রমিক কল্যাণ আইন ও তহবিল সম্পর্কে অবগত নন। শ্রমিক প্রতিনিধিদের দাবি, প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশে শ্রমিকদের অংশীদারিত্বের বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী সহজভাবে নেন না আর এক ধরনের অনীহা থেকেই সরকারি তহবিলে অর্থ জমা দেয়ার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা আগ্রহ দেখান না। ফলে সাড়া পাচ্ছে না শ্রমিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে গঠিত এ তহবিল।
সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেড বিদ্যুৎ খাতে দেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। তহবিলে অর্থ জমা দিতে সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার পরও তাতে কোনো সাড়া দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ খাতের সামিট, হরিপুর কভান্টাসহ কল্যাণ তহবিলে একইভাবে সাড়া দেয়নি শতাধিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে আবুল খায়ের গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, স্কয়ার গ্রুপ, আকিজ গ্রুপের মতো খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বেশির ভাগই সরকারের তরফ থেকে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে অর্থ জমা দেয়া সংক্রান্ত চিঠি প্রাপ্তির বিষয়টি স্বীকার করেনি। পাশাপাশি অনেক প্রতিষ্ঠান আইন সম্পর্কে অবগত নয় বলে জানায়।
আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খালেদ হোসেন বলেন, ‘সরকারের এ ধরনের কোনো আইন বা তহবিলের বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত নই। কোনো চিঠি সরকারের তরফ থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠানে এসেছে, এমনটিও জানা নেই। আমি মনে করি, শ্রমিক কল্যাণে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির বিষয়টিকে আরো উত্সাহিত করা উচিত।’
তবে এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ গ্রহণযোগ্য নয় মন্তব্য করে হোসেন খালেদ বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মীদের পারফরম্যান্স বোনাস হিসেবে লভ্যাংশ শেয়ার করা হয়। অন্য প্রতিষ্ঠানে এমনটা করা হচ্ছে কিনা তা বলতে পারব না। কিন্তু এ পন্থায় আমাদের প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ শেয়ার করা হচ্ছে।’
শ্রমিক প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শ্রম আইন, ২০০৬-এ শ্রমিক কল্যাণে লাভের ৫ শতাংশ অর্থ ব্যয়ের নির্দেশনা ছিল। তবে বাস্তবায়নে সরকারি নজরদারির তেমন কোনো ধারা ছিল না। এছাড়া আইন বাস্তবায়নে বিধিমালা না থাকায় আইনটি কার্যকর করার বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি।
২০১৩ সালে আইন সংশোধনের পর সরকারি তহবিলে অর্থ জমা দেয়াসহ আইন প্রতিপালনে বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেয়ার মতো তত্পরতাও শুরু হয়। তবে ফাউন্ডেশন কার্যকর করার বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ তেমন একটা নেয়া হয়নি। পাশাপাশি রয়েছে শ্রম আইন পরিপালনে ব্যবসায়ীদের অনীহা ও অসচেতনতা। সব মিলিয়েই তহবিলটির আকার এখনো স্ফীত নয়।
জানা যায়, ২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ১০০ টাকা লাভের বিপরীতে ৫ টাকা শ্রমিক কল্যাণে ব্যয়ের বাধ্যবাধকতা ছিল। সে আইন অনুযায়ী শ্রমিক কল্যাণে প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ তহবিলে ৫ টাকার ৮০ শতাংশ (৪ টাকা) শ্রমিকদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার পর বাকি ২০ শতাংশ (১ টাকা) শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে জমা রাখার কথা।
এদিকে সংশোধিত ২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী ৫ টাকার ৮০ শতাংশ অংশগ্রহণ তহবিলে রাখার পাশাপাশি ১০ শতাংশ (দশমিক ৫ টাকা) সরকারের বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে ও বাকি ১০ শতাংশ (দশমিক ৫ টাকা) শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে রাখতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে সংশোধিত আইনে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের পরিচালনা বোর্ড গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত তহবিলে জমা পড়েছে মাত্র ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪৭৬ টাকা। আর এ তহবিলে এ পরিমাণ অর্থ জমা দেয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৬। তহবিলে অর্থ জমা দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই বহুজাতিক। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে পরিচালিত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেই স্থানীয় শ্রম আইন সম্পর্কিত সচেতনতা বেশি। ফলে আইন প্রতিপালনে বহুজাতিকদের সংখ্যা বেশি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দীন আহমেদ বলেন, আইনটি সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। আবার যারা জানেন, তারা মানতে চান না। ১৯৬৮ সালের শ্রম আইন থেকেই প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ শ্রমিকদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার কথা ছিল। ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পরে এর পরিমাণ ৫ শতাংশ করা হয়। কিন্তু এ আইন প্রতিপালনে ব্যবসায়ীরা সবসময়ই অনীহা প্রকাশ করে এসেছেন। আর আইন প্রতিপালন হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সরকারেরও তেমন জোরালো পর্যবেক্ষণ নেই।
তিনি আরো বলেন, সর্বশেষ সংশোধিত আইনে ৫ শতাংশের ১০ শতাংশ সরকারের তহবিলে জমা দেয়ার বিষয়টি আসার পর সরকার এ আইন প্রতিপালনে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে সরকারের উচিত হবে লভ্যাংশের ৫ শতাংশ কর্মীদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়া হচ্ছে কিনা তা নজরদারি করা। আর সরকারি অডিট প্রতিষ্ঠান দ্বারা এ ধারা প্রতিপালনে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো। কারণ ৫ শতাংশ ভাগ করে নেয়ার আইন প্রতিপালন হলে স্বাভাবিকভাবেই সরকারের তহবিলে অর্থ জমা পড়তে শুরু করবে। বাংলাদেশে লাভজনক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনুযায়ী এক বছরে ৬৬ কোটি টাকা খুবই কম।
জানা গেছে, সরকারের তহবিল থেকে শ্রমিক ও তার পরিবারের কল্যাণ সাধন, শ্রমিক ও তার পরিবারের কল্যাণে বিভিন্ন প্রকার প্রকল্প গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন, অক্ষম শ্রমিকদের আর্থিক সাহায্য প্রদান, অসুস্থ শ্রমিকের চিকিত্সার ব্যবস্থা বা আর্থিক সাহায্য প্রদান, দুর্ঘটনায় কোনো শ্রমিকের মৃত্যু ঘটলে তাহার পরিবারকে সাহায্য প্রদানসহ শ্রমিকদের বিবিধ কল্যাণে ব্যয় করা হবে। এরই মধ্যেই এ তহবিলের সুফল ভোগ করতে শুরু করেছেন নির্মাণ শ্রমিক ও অটো মেকানিকরা।
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন পরিচালনা বোর্ডের সদস্য সচিব শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ফয়জুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানই নতুন এ আইন ও এর বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে জানে না। ফলে আইনের প্রতিপালন করা যাচ্ছে না। তবে তহবিলটি আরো কার্যকর করার বিষয়ে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তহবিল পরিচালনা বোর্ডের সর্বশেষ বৈঠকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরির মাধ্যমে এ আইন প্রতিপালনে পর্যায়ক্রমে চাপ দেয়া হবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে। নীতিগতভাবে মন্ত্রণালয় থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তিনি আরো জানান, বর্তমানে শ্রম আইনের ধারা থেকে কোনো প্রতিষ্ঠান যখন অব্যাহতি চায়, তখন লভ্যাংশ জমা দেয়ার বিপরীতে সে সুবিধা প্রদান করা হয়। আর এভাবেই পর্যায়ক্রমে শ্রমঘন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আইন সম্পর্কে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এটা প্রাথমিক ব্যবস্থা।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, তহবিলে অর্থ জমা দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে কোট্স বাংলাদেশ লি., রেনাটা এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লি., রেনাটা লিমিটেড, ফু-ওয়াং সিরামিক, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ, নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড, লাফার্জ সুরমা লিমিটেড, টিএম টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস লিমিটেড, সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড, রবি আজিয়াটা লিমিটেড, রেকিট বেনকিজার (বাংলাদেশ) লিমিটেড, আরএকে সিরামিক (বাংলাদেশ) লিমিটেড, গ্রামীণফোন, হুয়াউয়ি টেকনোলজিস (বিডি), লিন্ডে বাংলাদেশ লি., ক্রাউন সিমেন্ট লিমিটেড, এসেনশিয়াল ড্রাগ্স কোম্পানি লিমিটেড, বার্জার পেইন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড, বাটা সু কোম্পানি (বাংলাদেশ) লি., হাইডেলবার্গ সিমেন্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লি. ও সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেড।
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের মহাসচিব ফারুক আহমেদ বলেন, ‘লভ্যাংশের ৫ শতাংশ ব্যয় করার আইন প্রতিপালনে কোনো মালিকেরই দ্বিমত নেই। পর্যায়ক্রমে আইনটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা যাবে বলে আমরা আশাবাদী।’