জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে বক্তৃতায় শেখ হাসিনা
উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের পাশে দাঁড়াতে হবে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৭:১০ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের মতো দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাসে এবং অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য পর্যাপ্ত অর্থের প্রয়োজন। বর্তমান অবস্থায় অভিযোজন প্রক্রিয়াকে আমরা আরো খারাপ হতে দিতে পারি না। তাই উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের মতো দেশের পাশে দাঁড়াতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন ২০১৪ এর ‘ন্যাশনাল অ্যাকশন অন অ্যামবিশন অ্যানাউন্সমেন্ট’ অধিবেশনে বক্তৃতাকালে এসব কথা বলেন।
এদিকে সিএনএন জানায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় কার্বন নি:সরণে বিশ্বকে দু্রত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এর আগে নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় সকাল আটটায় অধিবেশন শুরু হয়। ইউএনজিএ’র প্রেসিডেন্ট স্যাম কু তেসার সভাপতিত্বে জাতিসংঘ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিশ্বের ১২০টির বেশি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ব্যবসায়ী, আন্তর্জাতিক সংস্থা, দাতা সংস্থা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ গণমাধ্যম জগতের বিশিষ্টজনরাও উপস্থিত ছিলেন। তবে এবারের সম্মেলনে নেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যদিও চীন পৃথিবীর প্রথম এবং ভারত দ্বিতীয় বৃহত্ কার্বন নিঃসরণকারী রাষ্ট্র। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনে দেয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত প্রায় ৩২ লাখ সোলার হোম ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। ১৫ লাখের মতো উন্নত চুলা সরবরাহ করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্রাটেজি এন্ড একশন প্লান বাস্তবায়ন করছে। স্বল্প আয়ের ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমরা প্রায় ৪০ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ সম্পদ অভিযোজন ও ক্ষতিকর প্রভাবে হ্রাসে বরাদ্দ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার উপর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন বন্যা, ঝড় হচ্ছে, লবণাক্ততা বাড়ছে। যে কারণে আমাদের উপকূলীয় আবাসভূমি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের প্রধান খাদ্যশস্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে; কিছু গবেষণায় বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের জিডিপি ২ থেকে ৩ শতাংশ কমে যেতে পারে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব কমাতে না পারলে এখনকার হিসাবের থেকে বেশি অর্থ অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যয় করতে হবে।
শেখ হাসিনা জোর দিয়ে বলেন, অভিযোজনের উপর আমাদের অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।
অভিযোজন ও প্রশমনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভারসাম্য বজায় রাখতে কাজ করতে হবে। এজন্য আর্থিক সহায়তা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও হস্তান্তর, সক্ষমতা বৃদ্ধি, কার্যক্রম ও সহায়তার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অবস্থান থেকে ‘ইন্টেন্ডেড ন্যাশনালি ডিটারমিন্ড কন্ট্রিবিউশন্স ( আইএনডিসি) অবশ্যই স্পষ্ট, পরিমাপযোগ্য ও যাচাইযোগ্য হবে। অন্যদিকে, বিশ্বকে কার্বন বাজেট প্রদান ও কার্বন নিঃসরণ কমাতে মনোযোগ দিতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাসে বেসরকারি অর্থায়ন আমাদের জন্য পরিপূরক হতে পারে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাসে অভিযোজন পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে অর্থ জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশে অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বৃহত্তর ‘ফাস্ট-ট্রাক-ফাইন্যান্স’ থাকতে হবে। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) এক্ষেত্রে বিবেচনায় আনতে হবে। দ্রুততম সময়ে জিসিএফের ভালো মূলধন আমাদের মতো দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত দেশের প্রভাব মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধিও গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা প্রযুক্তির জন্যও প্রযোজ্য। জীবন রক্ষাকারী প্রযুক্তির প্রাপ্তি ও
অভিযোজনমূলক প্রযুক্তির উন্নয়নে সহায়তা দেয়ার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি আহবান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের গড় মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ কখনো ছাড়িয়ে যাবে না। জলবায়ু স্বাভাবিক রেখে উন্নয়ন ঘটাবে এবং কম কার্বন নিঃসরণ করবে। এটা আমাদের অঙ্গীকার। এক্ষেত্রে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোকে আমাদের মতো দেশগুলোকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যথাযথ প্রতিদান দিতে হবে।
মূলত ২০১৫ সালে একটি বৈশ্বিক ও অর্থপূর্ণ জলবায়ু চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যেই এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। জাতিসংঘ চায়, বিশ্বনেতারা এ সম্মেলনে এসে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তাদের সাহসী পদক্ষেপের কথা ব্যক্ত করুক। সম্মেলন বিষয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
হলিউড অভিনেতা মর্গান ফ্রিম্যানের উপস্থাপনায় ও লিন লেয়ারের প্রযোজনায় একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে সম্মেলনের শুরু হয়। এরপর ভবিষ্যত্ করণীয় সম্পর্কে নিজের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডা ব্লাসিও, ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ চেয়ারপারর্সন রাজেন্দ্র পাচৌরি, ইউএনইপির শুভেচ্ছা দূত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর, অভিনেতা লি বিংবিং, ইউএন ম্যাসেঞ্জার অব পিস হিসেবে নতুন নিয়োগ পাওয়া হলিউড অভিনেতা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও অন্যান্যের মধ্যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
নরওয়ের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেখ হাসিনার
জলবায়ু সম্মেলনে বক্তব্যদান শেষে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী এরনা সলবার্গের সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ সদর দফতরের দ্বিপক্ষীয় কক্ষে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী তথ্য প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী নরওয়ের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। তিনি নরওয়েকে বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ করার আহবান জানান। নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপের প্রশংসা করেন এবং তার কারণেই এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। বৈঠকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ইত্তেফাককে এসব কথা জানান। তিনি বলেন, দুই নেতা পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭ টায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামার দেয়া অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে যোগদান করার কথা রয়েছে।