কঠিন শর্তে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার
চীনের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে কাল ইআরডির বৈঠক
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ
চীনের কাছ থেকে কঠিন শর্তে ৬০০ কোটি ডলারের ঋণ নিচ্ছে সরকার। পাঁচটি খাতের উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে দেশটির এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে এ ঋণ নেয়া হবে। এরই ধারাবাহিকতায় কাল মঙ্গলবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে চীনের এক্সিম ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলের আলোচনা হবে। শিগগিরই দেশটির সঙ্গে ঋণ চুক্তির বিষয়ে একটি রোডম্যাপও করছে সরকার। এ ঋণ আগের চেয়ে বেশি সুদের বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
প্রস্তাবিত বড় প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৪০০ কোটি ডলার ব্যয়ে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প, ৮০ কোটি ডলার ব্যয়ে যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে রেল সেতু নির্মাণ, ২০ কোটি ডলার ব্যয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ইনফো সরকার-২ প্রকল্প, প্রায় ১৭ কোটি ডলার ব্যয়ে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ফর ডিজিটাল বাংলাদেশ (টিএনটি) প্রকল্প, প্রায় ২০ কোটি ডলার ব্যয়ে ডেভেলপমেন্ট অব কক্সবাজার এয়ারপোর্ট প্রকল্প ও ১৮ কোটি ডলার ব্যয়ে এস্টাবলিশমেন্ট অব ফোর টিয়ার ন্যাশনাল ডাটা সেন্টার নির্মাণ। এছাড়া আছে বিদ্যুৎ খাতের আওতায় প্রি-মিটারিং প্রকল্প, আধুনিক ট্রান্সফরমার ক্রয় প্রকল্প ও চট্টগ্রামে অয়েল রিফাইনারি স্থাপন প্রকল্প। এগুলোর মধ্যে একাধিক প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয় ধরে অনুমোদনের বিষয়টি পরিকল্পনা কমিশন এবং বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নজরে এসেছে।
প্রকল্পগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে ঢাকায় আসছে চায়না এক্সিম ব্যাংকের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল। আগামীকাল এ নিয়ে শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে ইআরডির সঙ্গে বৈঠক করবে তারা। এ বৈঠকে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন ইআরডি সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন। অনুষ্ঠেয় বৈঠকে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর ঋণের সুদহার এবং কোন প্রকল্পে কত অর্থ বিনিয়োগ করবে তারা, সে বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব আসিফ-উজ-জামান বণিক বার্তাকে বলেন, চীনের এক্সিম ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে আসছে। তবে সেখানে আলোচনার ইস্যু সম্পর্কে এ মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব নয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের শীর্ষপর্যায়ের নির্দেশে ব্যয়বহুল ঋণের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। এমন চড়া সুদে বায়ার্স ক্রেডিট নিলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হবে বেশি। কারণ যেসব প্রকল্প নেয়া হচ্ছে, সেগুলোর ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবার নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ দেয়া হবে। ফলে কাজের মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন রয়েছে, একই সঙ্গে ব্যয় নিয়েও অস্বস্তি রয়েছে। এর পরও চীনের কাছ থেকে একের পর এক ঋণ নেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রস্তাবিত প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বড় গঙ্গা ব্যারাজ। প্রায় ৩১ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রকল্পটি নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সাত বছরের বেশি সময় ধরে চলছে সমীক্ষা-কর্মশালা, সভা ও সেমিনার। দীর্ঘ সময় পর প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। এ প্রকল্পে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। এজন্য ২০০৫ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পে ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করতেই পার হয়ে গেছে সাত বছরের বেশি সময়। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু না হওয়ায় এরই মধ্যে গঙ্গানির্ভর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩৭ শতাংশ এলাকার কৃষি, মৎস্য উৎপাদন ও নদ-নদীগুলোয় নৌ-চলাচল উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হচ্ছে। একই সঙ্গে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ছে এসব অঞ্চলে।
প্রকল্পগুলোর মধ্যে আরেকটি হচ্ছে যমুনা নদীর ওপর বিদ্যমান সেতুর সমান্তরাল ডুয়াল গেজ ডাবল ট্র্যাকবিশিষ্ট একটি রেল সেতু নির্মাণ। চীনের অর্থে প্রায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। এতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। চলতি বছরের নভেম্বরে বিশদ নকশা ও নির্মাণকাজ তদারকির জন্য পরামর্শক নিয়োগের লক্ষ্যে দরপত্র আহ্বান করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ২০১৬ সালের আগস্টের মধ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নকশা দাখিল, দরপত্র দলিল ও ডিপিপি প্রণয়নের কথা রয়েছে। এর পর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। ২০১৭ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু হবে। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্প ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
ইআরডির হিসাবে চীনের অর্থায়নে প্রস্তাবিত প্রকল্পের গ্র্যান্ট এলিমেন্ট ২৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এগুলো আগের নেয়া ঋণের তুলনায় বেশি সুদের। বর্তমানে চলমান প্রকল্পগুলোর গ্রেস পিরিয়ড সাত বছর, সুদের হার ১ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রস্তাবিত প্রকল্পে সুদের হার ২ শতাংশ, গ্রেস পিরিয়ড মাত্র চার বছর। ঋণগুলো ২০ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এর বাইরে আরো রয়েছে দশমিক ২ শতাংশ কমিটমেন্ট ফি ও ম্যানেজমেন্ট ফি দশমিক ২ শতাংশ। অন্যান্য ফি মিলে প্রায় ৫ শতাংশের উপরে সুদ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে; যেখানে জাপানের সহযোগিতা সংস্থা জাইকার সুদ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ ও বিশ্বব্যাংকের দশমিক ৭৫ শতাংশ।