মদীনা মুনাওয়ারা, মসজিদে নববী ও রওজা শরীফের মর্যাদা ও আদব/রূহুল আমীন খান
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৯:২৭ পূর্বাহ্ণ
রূহুল আমীন খান
অবশেষে সউদী রাষ্ট্রদূত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করে আমাদের তথা মুসলিম উম্মার বিচলন, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়েছেন। বিজ্ঞপ্তিতে তিনি জানিয়েছেন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর রওজা মুবারক থেকে তাঁর দেহ সরিয়ে নেয়ার খবর সত্য নয় বলে জানিয়েছেন সউদী আরব কর্তৃপক্ষ। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দুই পবিত্র মসজিদ- মসজিদ আল হারাম এবং মসজিদ আন-নববী বিষয়ক জেনারেল প্রেসিডেন্সি’র ব্যাখ্যামূলক বিবৃতিও সংযুক্ত করা হয়েছে। এতে মক্কা শরীফের পবিত্র মসজিদুল হারাম ও মদীনা শরীফের মসজিদে নববী পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র আহমাদ মুহাম্মদ আল-মানসুরির বরাত দিয়ে জানানো হয় “বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর রওজা মুবারক থেকে তাঁর দেহ সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সউদী সরকার’ সংক্রান্ত যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা মোটেও সঠিক নয়। বিবৃতিতে আল মানসুরী মন্তব্য করেন, এক জন শিক্ষাবিদের দেয়া ওই প্রস্তাব সউদী আরব সরকারের নির্দেশনার প্রতিফলন নয়। প্রস্তাবটি ওই শিক্ষাবিদের একান্তই নিজস্ব। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার নীতি অনুসরণ করে ওই মন্তব্য করেছেন।”
তবু প্রশ্ন জাগে ওই শিক্ষাবিদের প্রস্তাব নিয়ে, তার গবেষণার বিষয় নিয়ে। পবিত্র কাবা তো এক গিরিসংকট স্থানে, লাখো মানুষের ভিড়ে এখানের কার্যাবলী সম্পাদন অত্যন্ত কষ্টকর- তাই বলে ক্বাবাকে কোনো দিগন্ত বিস্তৃত মরু ময়দানে স্থানান্তরের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে কি? পবিত্র হাজরে আসওয়াদ কোনো অজুহাতেই স্থানান্তর করা যাবে কি? মিনার জামারাতের সংকীর্ণ স্থানে নির্দিষ্ট তারিখে কংকর নিক্ষেপ করতে গিয়ে কত হাজী সাহেবানের প্রাণ গিয়েছে, তাই বলে এই জামারাত কোনো উন্মুক্ত ময়দানে স্থানান্তর করা তো দূরের কথা, সরিয়ে নেয়ার বিষয় চিন্তাও কারা যায় কি? যায় না, যাবে না। তেমনি, সরিয়ে নেয়াটা কোন গবেষণারও বিষয় হতে পারে না। এ নিয়ে কোন পন্ডিতের প্রস্তাব দেয়ারও ইখতিয়ার থাকতে পারে না। অনুরূপই মসজিদে নববী, রওজা মুবারক, মহানবীর কবর শরীফ, তাঁর দেহ মুবারক সরিয়ে নেয়ার বা স্থানান্তরের বিষয়টিও কোন গবেষণার বিষয়বস্তু বা এ নিয়ে কোনো প্রস্তাব দেয়ার ইখতিয়ারও কোনো গবেষক, শিক্ষাবিদ বা চিন্তাবিদের থাকতে পারে না। পবিত্র ক্বাবা, ছাফা-মারওয়ার মধ্যবর্তী সায়ীর স্থান, আরাফা, মুজদালিফা, মিনা, জামারাতের স্থান যেমন স্বয়ং আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল কর্তৃক নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট ঠিক তেমনি হিযরতস্থল মদীনা, মসজিদে নববী, মহানবী (স.)-এর রওজা মুবারক- কবর শরীফের স্থানও আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কর্তৃক নির্ধারিত ও সুনির্দিষ্ট। এটাই চূড়ান্ত। এটাই চিরন্তন সত্য। এ নিয়ে নতুন করে চিন্তা বা গবেষণা করার কোনই অবকাশ নেই। প্রস্তাব পেশ করার তো প্রশ্নই আসে না।
শেষনবী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) যে আরবভূমিতে আবির্ভূত হবেন, তিনি যে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে আসবেন, এ কথা পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে বর্ণিত ছিল। ইয়াহুদীগণ তা জানত। এ কথা জানত ইয়ামেনী বিদ্বান ব্যক্তিরাও। তাই তাদের একটি দল ইয়াসরিবে (মদীনার হিযরত-পূর্ব নাম) গিয়ে বসবাস ও নবীজীর আগমনের ইন্তেজার করতে থাকেন। এমনকি ইয়ামেনের বাদশা ‘তোব্বা’ ইয়াসরিবে নবীজী তাশরীফ আনলে সেখানে অবস্থানের জন্য একটি ভবনও নির্মাণ করেন এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন খাদেমও নিযুক্ত করে রাখেন। বংশ পরম্পরায় সেই ভবনে হযরত আবু আইয়ূব আনসারী অবস্থান করছিলেন। ইয়াসরিবে হিযরত করে যাবার পর সবাই যখন তাঁকে নিজ নিজ গৃহে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন জানাতে লাগলেন তখন নবীজী উটের লাগাম ছেড়ে দিয়ে বললেন, আমার উট যেখানে গিয়ে বসে পড়বে সেখানেই হবে আমার অবস্থান ও আবাসস্থল। লাগাম ছাড়া উটটি প্রথমে গিয়ে এক জায়গায় কিছুক্ষণ বসে উঠে যায় এবং হাঁটতে হাঁটতে হযরত আবু আইয়ূব আনসারীর গৃহ-সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসে থাকে। নবীজী সেখানে অবতরণ করে তাঁর গৃহে তাশরীফ নেন। এর কিছু দিন পরে উট যেখানে প্রথম বসেছিল সেই স্থানে মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্মিত হয় নবী-সহধর্মীণী উম্মাহাতুল মুমিনীনদের হুজরা। মসজিদ সংলগ্ন মা আয়েশার হুজরাতেই নবীজীর ইন্তেকাল হয়। ইন্তেকালের সময় তিনি যে বিছানাটিতে শায়িত ছিলেন সেটি সরিয়ে সেখানেই খনন করা হয় কবর শরীফ এবং সে কবরেই দাফন করা হয় নবীজীকে। আজও সেখানে তিনি শায়িত আছেন এবং থাকবেন পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত। বিশ্বনবী (স.)-এর রওজা মোবারকের স্থান কি আল্লাহ ও রাসূল (স.) কর্তৃক নির্ধারিত?
তবু প্রশ্ন জাগে ওই শিক্ষাবিদের প্রস্তাব নিয়ে, তার গবেষণার বিষয় নিয়ে। পবিত্র কাবা তো এক গিরিসংকট স্থানে, লাখো মানুষের ভিড়ে এখানের কার্যাবলী সম্পাদন অত্যন্ত কষ্টকর- তাই বলে ক্বাবাকে কোনো দিগন্ত বিস্তৃত মরু ময়দানে স্থানান্তরের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে কি? পবিত্র হাজরে আসওয়াদ কোনো অজুহাতেই স্থানান্তর করা যাবে কি? মিনার জামারাতের সংকীর্ণ স্থানে নির্দিষ্ট তারিখে কংকর নিক্ষেপ করতে গিয়ে কত হাজী সাহেবানের প্রাণ গিয়েছে, তাই বলে এই জামারাত কোনো উন্মুক্ত ময়দানে স্থানান্তর করা তো দূরের কথা, সরিয়ে নেয়ার বিষয় চিন্তাও কারা যায় কি? যায় না, যাবে না। তেমনি, সরিয়ে নেয়াটা কোন গবেষণারও বিষয় হতে পারে না। এ নিয়ে কোন পন্ডিতের প্রস্তাব দেয়ারও ইখতিয়ার থাকতে পারে না। অনুরূপই মসজিদে নববী, রওজা মুবারক, মহানবীর কবর শরীফ, তাঁর দেহ মুবারক সরিয়ে নেয়ার বা স্থানান্তরের বিষয়টিও কোন গবেষণার বিষয়বস্তু বা এ নিয়ে কোনো প্রস্তাব দেয়ার ইখতিয়ারও কোনো গবেষক, শিক্ষাবিদ বা চিন্তাবিদের থাকতে পারে না। পবিত্র ক্বাবা, ছাফা-মারওয়ার মধ্যবর্তী সায়ীর স্থান, আরাফা, মুজদালিফা, মিনা, জামারাতের স্থান যেমন স্বয়ং আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল কর্তৃক নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট ঠিক তেমনি হিযরতস্থল মদীনা, মসজিদে নববী, মহানবী (স.)-এর রওজা মুবারক- কবর শরীফের স্থানও আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কর্তৃক নির্ধারিত ও সুনির্দিষ্ট। এটাই চূড়ান্ত। এটাই চিরন্তন সত্য। এ নিয়ে নতুন করে চিন্তা বা গবেষণা করার কোনই অবকাশ নেই। প্রস্তাব পেশ করার তো প্রশ্নই আসে না।
শেষনবী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) যে আরবভূমিতে আবির্ভূত হবেন, তিনি যে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে আসবেন, এ কথা পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে বর্ণিত ছিল। ইয়াহুদীগণ তা জানত। এ কথা জানত ইয়ামেনী বিদ্বান ব্যক্তিরাও। তাই তাদের একটি দল ইয়াসরিবে (মদীনার হিযরত-পূর্ব নাম) গিয়ে বসবাস ও নবীজীর আগমনের ইন্তেজার করতে থাকেন। এমনকি ইয়ামেনের বাদশা ‘তোব্বা’ ইয়াসরিবে নবীজী তাশরীফ আনলে সেখানে অবস্থানের জন্য একটি ভবনও নির্মাণ করেন এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন খাদেমও নিযুক্ত করে রাখেন। বংশ পরম্পরায় সেই ভবনে হযরত আবু আইয়ূব আনসারী অবস্থান করছিলেন। ইয়াসরিবে হিযরত করে যাবার পর সবাই যখন তাঁকে নিজ নিজ গৃহে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন জানাতে লাগলেন তখন নবীজী উটের লাগাম ছেড়ে দিয়ে বললেন, আমার উট যেখানে গিয়ে বসে পড়বে সেখানেই হবে আমার অবস্থান ও আবাসস্থল। লাগাম ছাড়া উটটি প্রথমে গিয়ে এক জায়গায় কিছুক্ষণ বসে উঠে যায় এবং হাঁটতে হাঁটতে হযরত আবু আইয়ূব আনসারীর গৃহ-সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসে থাকে। নবীজী সেখানে অবতরণ করে তাঁর গৃহে তাশরীফ নেন। এর কিছু দিন পরে উট যেখানে প্রথম বসেছিল সেই স্থানে মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্মিত হয় নবী-সহধর্মীণী উম্মাহাতুল মুমিনীনদের হুজরা। মসজিদ সংলগ্ন মা আয়েশার হুজরাতেই নবীজীর ইন্তেকাল হয়। ইন্তেকালের সময় তিনি যে বিছানাটিতে শায়িত ছিলেন সেটি সরিয়ে সেখানেই খনন করা হয় কবর শরীফ এবং সে কবরেই দাফন করা হয় নবীজীকে। আজও সেখানে তিনি শায়িত আছেন এবং থাকবেন পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত। বিশ্বনবী (স.)-এর রওজা মোবারকের স্থান কি আল্লাহ ও রাসূল (স.) কর্তৃক নির্ধারিত?
এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর- হ্যাঁ, অবশ্যই তা নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত। অবশ্য এ আলোচনা দীর্ঘ এবং দলিল প্রমাণ অগণিত। স্বল্প পরিসর এ নিবন্ধে তা তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবুও যেহেতু রওজা শরীফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা, জিয়ারত করা, কবর শরীফ নিয়ে কথা উঠেছে তাই এ সম্পর্কে আমরা কিছুটা আলোকপাত করার প্রয়াস পাব।
বেহেস্তের মাটি নূরান্বিত। সেই বেহেস্তের একটি টুকরা মদীনা মুনওয়ারার মসজিদে নববী ও প্রিয় নবী (স.) এর কবর মোবারক আজ যেখানে অবস্থিত সেখানে অর্থাৎ কবর শরীফ থেকে নবী (স.) মিম্বর পর্যন্ত স্থানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্থাপন করে দেন, যা “রিয়াদুল জান্নাহ” নামে পরিচিত।
শেফাউস সুদূর, ওফা, শরহে মাওয়াহেবে জোরকানী, লদুন্নীতে কাবুল আহবার (রা.) এর বরাতে এভাবে বর্ণিত আছে: আল্লাহ পাক যখন নূরে মোহাম্মদীকে মাটির সাথে মিলাতে ইচ্ছে করলেন তখন জিবরাঈল (আ.) কে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে মাটি নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। জিবরাঈল (আ.) একদল ফেরেশতাসহ এসে মদীনা মুনাওয়ারায় যেখানে এখন নবীজীর কবর মোবারক সেখান থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে গেলেন। নূরে মুহাম্মদীকে মিলান হলো সেই মাটির সাথে। অর্থাৎ, যে স্থানের মাটি থেকে সৃষ্টি, সেখানেই তাঁর শেষ শয়ন, সেখানেই তাঁর অবস্থান, রওজা-কবর এবং সেখান থেকেই হাশর ময়দানে উত্থান।
মদীনা মুনাওয়ারার গুরুত্ব ও মর্যাদা
তিনটি শহরের গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। মক্কা, মদীনা ও জেরুজালেম। মক্কার বিশেষ গুরুত্ব ক্বাবা শরীফের জন্য, মদীনার গুরুত্ব রওজা শরীফ ও মসজিদে নববীর জন্য, জেরুজালেমের গুরুত্ব মসজিদুল আকসা ও আম্বিয়ায়ে কিরামের স্মৃতির জন্য।
মদীনার নাম ছিল ইয়াসরিব। নবীজীর হিজরতের ফলে এর নাম হয় মদীনাতুন্নবী- মদীনা মুনাওয়ারা- নবীর শহর, নূরান্বিত শহর। হিজরতের পর থেকে ইন্তেকালের সময় পর্যন্ত এখানেই বসবাস করেছেন দয়াল নবী। এটাই হয় ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী। এখান থেকে ইসলামের আলো ছড়িয়ে যায় সারা দুনিয়ায়। নবীজীর জন্যই এ শহরের প্রতি প্রতিটি মুসলমানের সীমাহীন আকর্ষণ, ভালবাসা।
প্রিয় নবী (স.) মদীনায়ে তায়্যেবার মর্যাদা সম্পর্কে বলেন, ইন্নামা তায়্যেবাতুন তুনফি জ্জুন্নুবা কামা ইউন্ফিল কিরু খবসাল হাদীদ। অর্থাৎ- মদীনা শরীফ পূত পবিত্র। গুনাহ্সমূহের ময়লা-কালিমা সে এমনভাবে নির্মল করে দেয় যেমন কামারের হাফর দূর করে দেয় লোহার ময়লা। (বুখারী)।
প্রিয় নবী (স.) প্রায়সময় মদীনা শরীফের কল্যাণ ও বরকতের জন্য দোয়া করতেন। এই দোয়ার মধ্যে তিনি এও বলতেন: “হে আল্লাহ, ইবরাহীম (আ.) আপনার বান্দা, বন্ধু ও নবী। আমিও আপনার বান্দা ও নবী। তিনি মক্কার জন্য আপনার নিকট দোয়া করেছেন, আমিও তেমনি আপনার নিকট মদীনার জন্য দোয়া করছি।”
রাসূলে পাক (স.) বলেছেন: “মদীনা আমার হিজরতের স্থান, এখানে আমার শয়ন কক্ষ, এখান থেকেই আমি হাশর ময়দানে উত্থিত হব। দিন-রাত সত্তর হাজার ফেরেশতা এখানে হাজির থাকেন।”
এই মদীনায়ে তায়্যেবার প্রতি আশেকে রাসূলদের কত গভীর ভালবাসা, কত হৃদয়ের টান, কত দুর্নিবার আকর্ষণ, কত আবেগ-উচ্ছ্বাস, কোন ভাষা দিয়েই তা বর্ণনা করা যাবে না। ১৫শ’ বছর ধরে কত কবিতা, কত গজল-কাসিদা রচনা করা হয়েছে, কত লেখক ভক্তিগাঁথা শ্রদ্ধাঞ্জলি দুনিয়ার বিভিন্ন ভাষায় নিবেদন করেছেন তার হিসাব-নিকাশ কেউ করতে পারবে না। এই শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের ধারাবাহিকতা চলছে, চলবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত। বিদ্বেষীরা যতই জ্বলে-পুড়ে মরুক, এই উত্তাল জোয়ারে কখনো ভাটা লাগবে না। মদীনা মুনাওয়ারায় রওজা মোবারক যিয়ারতে যাত্রাকে-সফরকে, যিয়ারতকে যতই নিরুৎসাহিত করা হোক তাতে পুণ্যার্থীদের ঢল একটুও কমবে না। দূর দেশে বসেও প্রেমিকদের আকুতি ধ্বনিত-রণিত হতে থাকবে।
পূবাল হাওয়া পশ্চিমে যাও বইয়া / যাওরে বইয়া এই গরীবের সালাম খানি লইয়া।
কিংবা- প্রিয় নবীর যিয়ারতে চলরে মদীনায় / দুনিয়ার জান্নাত গো গুলজারে মদীনা।
ইয়া নবী ইয়া কামলিওয়ালা, তুমি মোরে লও ডেকে মদীনা।
তোমার বিচ্ছেদ অনলে/যায় গো আমার হৃদয় জ্বলে
আমি যে আর সইতে পারি না
তুমি আমায় লও ডেকে মদীনা।।
মহাকবি আব্দুর রহমান জামীর মত নবী প্রেমিকরা এই নিবেদন পেশ করতেই থাকবে : “ও নূর বদন বাহির করো খোলগো চাদর এমানী/ঐ চেহারা দেখে আমার ধন্য করি যেন্দেগানী।”
মসজিদে নববীতে এক রাকাত নামাজ পড়ার বিনিময়ে আল্লাহ পাক ৫০ হাজার রাকাত নামাজের সওয়াব দান করেন (এ নিয়ে বিভিন্ন রেওয়ায়েত রয়েছে)। কারণ তো এই, নবীজী এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন, এখানে নামাজ পড়েছেন। মক্কার হারাম এরিয়ার মত মদীনার একটি হারাম এরিয়া নির্ধারিত রয়েছে। কারণ তো এই, এই জনপদে নবীজী বসবাস করেছেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন বেহেস্তের একটি টুকরা এখানে স্থাপন করে দিয়েছেন। কারণ এই, বেহেস্তি জমিনের নূরান্বিত মাটিই নূরে মুহাম্মদীর সাথে সম্পৃক্ত করবেন, এখানেই তাঁর দরবার হবে, এখানেই তিনি ইন্তেকাল করবেন, এখানেই তাঁর দাফন হবে, কবর হবে, রওজা হবে। সব-ই আল্লাহর ইচ্ছা ও এরাদা, সব তাঁরই মহাপরিকল্পনা।
আল্লাহর হাবীব (স.) বলেন: “যে ব্যক্তি মদীনা শরীফে মৃত্যুবরণ করবে, আমি কিয়ামতের দিন তার সুপারিশকারী হব।” নবীজী আরো বলেছেন: “যে ব্যক্তির মদীনা শরীফে মৃত্যুবরণ করার মত সুযোগ আছে সে যেন মদীনাতেই মৃত্যুবরণ করে। আমি কিয়ামতের দিন তার জন্য সাক্ষ্য দিব এবং তার জন্য সুপারিশকারী হব।”
ইন্তেকালের পরেও নবীজী (স.) তাঁর কবর শরীফে জিন্দা আছেন
ইন্তেকালের পরে নবীজীকে কোন্ স্থানে দাফন করা হবে এ নিয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত প্রকাশ করছিলেন। তখন হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা.) বললেন: “আমি রাসূল (স.) কে বলতে শুনেছি, যেখানে নবীর ইন্তেকাল হয় সেখানেই তাঁকে দাফন করতে হয়।” তাঁর থেকে আরও বর্ণিত আছে: “যেখানে তাঁর রূহ কবজ হয়েছে সেখানেই তাঁকে দাফন কর। ওই পবিত্র জায়গা ব্যতীত তাঁর রূহ কবজ করা হয়নি।” এ সিদ্ধান্তের পর হযরত আবু তালহা (রা.) নবীজীর শয়নকৃত বিছানাটি উঠালেন। যেখানে তিনি ইন্তেকাল করেছেন, এরপর ওই বিছানার নিচেই তাঁর কবর খনন করা হয়।
কবর শরীফ তৈরি হয়ে গেলে নূরানী লাশ তার ভিতর রাখা হলো। লাশ রাখার জন্য হযরত আব্বাস, হযরত আলী, হযরত ফজল ও হযরত কাসাম (রা.) কবরে নামলেন। কাজ শেষে তিনজন উপরে উঠে এলেন। কেবল হযরত কাসাম (রা.) আরও কিছুক্ষণ কবরে থাকলেন। উঠে এসে তিনি বললেন, আমি দয়াল নবীর মোবারক ওষ্ঠদ্বয় নড়তে দেখে কান লাগিয়ে শুনতে পেলাম তিনি মৃদু আওয়াজে বলছিলেন, ইয়া রাব্বী হাবলি উম্মতী, উম্মতী।
হযরত মাওলানা শাহ্ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) তাঁর ‘জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব’ কিতাবে লিখেছেন এবং তাফসিরে কুরতুবিতেও রয়েছে: হযরত আলী (রাঃ) বর্ণনা করেন: রাসূল (স.)-এর ইন্তেকালের তিন দিন পর এক আরাবী মুসলমান এসে প্রিয় নবী (স.)-এর কবরে মাথা ঠেকিয়ে তাঁর কবর থেকে মাটি নিয়ে নিজ মাথায় ছিটাতে লাগলেন আর বিনয়ের সাথে বলতে লাগলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আল্লাহর কুরআন শুনিয়েছেন আমরা শুনেছি, আপনি আমাদেরকে শিখিয়েছেন আমরা শিখেছি। আল্লাহ পাক তার পবিত্র কুরআনে বলেছেন: ওয়ালাও আন্নাহুম যলাম… অর্থাৎ – ‘যারা নিজেদের প্রতি যুলুম করে… তারা আপনার নিকট এলে এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলে, আপনিও (হে রাসূল) তাদের জন্য ক্ষমা চাইলে তারা অবশ্যই আল্লাহকে পরম ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু রূপে পাবে।’ (সূরা নিসা, ৬৪ আয়াত) অর্থাৎ, আল্লাহ তাদের সব গুনাহ মাফ করে দিবেন। এ আয়াতটি তিলাওয়াত করে লোকটি বলতে লাগল: আমি আমার প্রতি জুলুম করেছি, গুনাহ করেছি, এখন আমি আপনার দরবারে হাজির হয়েছি। হযরত আলী (রা.) বলেন: তক্ষুণি রওজা শরীফ থেকে আওয়াজ এলো, ‘তোমাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে’। তাফসীরে ইবনে কাসীরে, কিতাবুল মুগনীতে এবং শরহে ছগিরেও ঘটনাটি বর্ণিত আছে।
হযরত আহমাদ কবীর রিফায়ী (রহ.) ছিলেন বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) এর ভাগিনা। হযরত বড়পীর (রহ.) ও রিফায়ী (রহ.) হজ করতে আসেন এবং হজের পরে রওজা শরীফ জিয়ারতে দাঁড়ান। তখন হযরত আহমাদ কবীর রিফায়ী আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলতে থাকেন: ‘ফী হালাতিল রোওদি রূহী কুনতু আরসিলুহা/তুকাব্বিলুল আরদা অহিয়া নায়িবাতী। ফাহজিহিল দৌলাতুল আশবাহ কাদ হাদারতু/ফামদুদ য়ামিনিকা কায় তাহযি বিহা শাফতী’। ওগো দয়াল নবী! আমি যখন অনেক দূরে নিজ দেশে ছিলাম তখন নিজ রূহকে পাঠিয়ে দিতাম আপনার পবিত্র রওজা চুম্বনের জন্য, সে চুম্বন করে যেতো। এখনতো আমি সশরীরে আপনার দরবারে উপস্থিত হয়েছি, তাই এখন মেহেরবাণী করে আপনার পবিত্র ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিন যেন আমি তা চুম্বন করে ধন্য হতে পারি। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে নবীজী তাঁর পবিত্র ডান হাতখানা কবর শরীফ থেকে বের করে বাড়িয়ে দিলেন, রিফায়ী (রহ.) আবেগভরে তা চুম্বন করে বেহুশ হয়ে পড়লেন। তখন রওজা শরীফে, মসজিদে ৯০ হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন।
নবীজী যে তাঁর কবর মোবারকে সশরীরে যিন্দা রয়েছেন তা ইয়াহুদী নাসারার বিশেষজ্ঞরাও বিশ্বাস করত। ৫৫৭ ঈসায়ী সালে সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গী (রহ.) এর শাসনকালে খৃস্টানদের একটি দল গোপন বৈঠক করে সিদ্ধান্ত করে, হযরত মুহাম্মদ (স.)-ই হচ্ছেন মুসলমানদের সাফল্য ও বিজয়ের উৎস। তাঁর লাশ যদি মদীনার রওজাপাক থেকে চুরি করে সরিয়ে এনে বিনষ্ট করে দেয়া যায় তবে মুসলমানদের পরাস্ত করা আর অসম্ভব হবে না। পরামর্শ অনুযায়ী তারা অতি ধূরন্দর দু’টি লোককে এজন্য নিযুক্ত করে তাদেরকে বিপুল অর্থ সম্পদ দিয়ে মদীনায় পাঠিয়ে দিল। লোক দুটি পাক্কা দরবেশ সেজে মদীনায় এসে রওজাপাকের অদূরে একটি বাড়ী ভাড়া নিয়ে গোপন অভিসন্ধি বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করল। তারা শহরের লোকদের মধ্যে প্রভুত দান-সদকা করতো তবে কখনো ওই হুজরা থেকে বের হতো না। এভাবে লোকদের মধ্যে তারা দানশীল কামেল দরবেশ হিসাবে পরিচিতি লাভ করলো। এদিকে সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গী পরপর তিনবার একই রাতে রাসূলুল্লাহ (স.) কে স্বপ্নযোগে দর্শন করলেন। প্রিয় নবী (স.) দুজন লোকের চেহারা সুস্পষ্ট রূপে দেখিয়ে সুলতানকে বললেন, এই জালেমদ্বয়ের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করো। স্বপ্ন দেখে সুলতান আঁতকে উঠলেন এবং প্রভাতেই মদীনা যাত্রার প্রস্তুতি নিলেন। সঙ্গে নিলেন অত্যন্ত দক্ষ বিশজন ঘোরসওয়ার সৈনিক এবং বিপুল অর্থ। অবিরাম ১৬ দিন পথ চলার পর তিনি মদীনায় এসে পৌঁছালেন এবং ঘোষণা দিলেন, তিনি মদীনাবাসীদের দান করবেন, সবাই যেন তাঁর নিকট এসে দান গ্রহণ করে, একজন লোকও যেন অনুপস্থিত না থাকে। রাজ-ফরমান অনুযায়ী মদীনার সকল লোক হাজির হল, দান গ্রহণ করতে লাগল কিন্তু সুলতান তাদের মধ্যে ওই দুষ্ট লোক দুটি, যাদের চেহারা নবীজী তাঁকে দেখিয়ে ছিলেন তাদেরকে দেখতে পেলেন না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, মদীনার সব লোকই কি এখানে এসেছে? কেউ কি বাকি নেই? লোকেরা আরজ করলো, হুজুর, সবাই-ই এসেছে কেবল দু’জন লোক ছাড়া, তারা ওলী আল্লাহ-দরবেশ। তারা হুজরা থেকে কখনো বের হন না। তিলাওয়াত ও ইবাদত বন্দেগীতেই সর্বদা মশগুল থাকেন। সুলতান বললেন, আমাকে ঐ হুজরায় তাদের নিকট নিয়ে চলুন, আমি তাদের সাথে সাক্ষাৎ করব। লোকজন নিয়ে সুলতান সেখানে হাজির হলেন এবং দেখতে পেলেন, তারা ঠিক সেই লোকই যাদেরকে প্রিয় নবী (স.) দেখিয়ে ছিলেন। সুলতানের মনে আর কোনই সন্দেহ রইল না। সুলতান তাদের সামনে কুরআন শরীফ খোলা অবস্থায় দেখলেন। সুলতান তাদেরকে বিছানা থেকে সরে আসার নির্দেশ দিলেন এবং মেঝেতে পাতা বিছানা তুলে ফেলে দেখতে পেলেন, সেখান থেকে একটি সুড়ঙ্গপথ রওজা শরীফের দিকে চলে গেছে। সেই সুড়ঙ্গপথে অগ্রসর হয়ে দেখলেন, সুড়ঙ্গটি প্রায় রওজার নিকটে পৌঁছে গেছে, আর দু’এক দিন খনন করলে কবর শরীফে নবীজীর দেহ মোবারক পর্যন্ত পৌঁছে যেত। পাপিষ্টদ্বয় দিনে ইবাদতের ভান করে কাটিয়ে দিত এবং গভীর রজনীতে সকলের নিদ্রামগ্ন অবস্থায় লাশ মোবারক সরিয়ে নেয়ার জন্য সুড়ঙ্গ খনন করত, আর খননকৃত মাটিগুলো বস্তায় ভরে পাহাড়ের ঢালে ফেলে দিয়ে আসত। ব্যাপার দেখে সকলে বিস্ময়ে, ভয়ে হতবাক! সুলতান তাদেরকে বন্দী করলেন, মৃত্যুদণ্ড দিলেন এবং তাদের লাশ জনসম্মুখে জ্বালিয়ে দিলেন। তিনি রওজা শরীফের চারপাশে মাটির গভীর থেকে সীসা ঢালাই করে মজবুত দেয়াল নির্মাণ করে এর সুরক্ষার ব্যবস্থা করলেন।
আর একটি ঘটনা
এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন তাবারী তাঁর ‘রিয়াজে নযরাহ’ কিতাবে। রাফেজী সম্প্রদায়ের কতিপয় দুর্বৃত্ত অনেক উপঢৌকন নিয়ে মদীনার আমীরের নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে প্রদান করল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত লোভী এবং ঐ সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরক্ত। তাঁর নিকট পাপিষ্টরা তাদের অভিপ্রায় প্রকাশ করল যে, তারা রওজা শরীফে ঢুকে সেখান থেকে হযরত আবু বকর (রা.) এবং হযরত ওমর (রা.) এর দেহ মোবারক সরিয়ে নিয়ে যাবে। তারা এ কাজে আমীরের অনুমতি ও সহায়তা কামনা করল। আমীর সম্মতি দিলেন এবং মসজিদে নববীর খাদেমকে নির্দেশ দিলেন, গভীর রাতে ঐ লোকগুলো হাজির হলে যেন দরজা খুলে দেয়া হয় এবং তাদের কাজে যেন বাঁধা না দেয়। নির্দেশ অমান্য করার কোন সাধ্য ছিল না খাদেমের। লোকজন এশার নামাজ পড়ে বিদায় হওয়ার পর ৪০ জন দুর্বৃত্ত শাবল কোদাল নিয়ে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করল এবং রওজা শরীফের দিকে পা বাড়াল। খাদেম এ দৃশ্য দেখছিলেন এবং নিরুপায় বসে কাঁদছিলেন। দুষ্কৃতকারীরা মসজিদে নববীর মিম্বর পর্যন্ত অগ্রসর হতে না হতেই হঠাৎ সবাই মাটির মধ্যে ধসে গিয়ে বিলীন হয়ে গেল।
আমীর প্রতীক্ষা করছিলেন তাদের জন্য। তারা ফিরে না আসায় খাদেমকে কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। খাদেম সব ঘটনা খুলে বললে তিনি গিয়ে ধসে যাওয়ার স্থান পরিদর্শন করলেন এবং ধসে যাওয়ার চিহ্ন প্রত্যক্ষ করলেন। ঘটনাটি অত্যন্ত মশহুর। তারিখে সাহমুতিসহ বিভিন্ন গ্রন্থে এর উল্লেখ আছে। (জববুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব)। এ ধরনের বিম্ময়কর ঘটনা বহু আছে, যদ্বারা রওজা শরীফে প্রিয় নবী (স.) যে সশরীরে জীবিত আছেন তার প্রমাণ মিলে।
নবীগণ কবর শরীফে যিন্দা এর দলীল
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, আম্বিয়ায়ে কেরাম নিজ নিজ কবরে যিন্দা আছেন এবং তাঁরা কবরে বসে নামাজ পড়েন। (বায়হাকী)।
প্রিয় নবী (স.) বলেন: মিরাজের রাতে আমি কুসাইবুল আহমার নামক স্থানে মূসা (আ.) এর কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম তিনি নামাজ পড়ছেন। (মুসলিম-নাসায়ী)।
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত: আম্বিয়ায়ে কেরামকে কবরে রাখার ৪০ দিন পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত তাঁরা আল্লাহর সম্মুখে নামাজরত থাকেন। (বায়হাকী)।
ইবনে মাজাহ শরীফে আছে: রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন: জুমার দিন তোমরা আমার উপর বেশি বেশি দরূদ পাঠ কর। এ দিনে ফেরেশতাগণ উপস্থিত হন। তোমাদের মধ্যে কেউ আমার উপর দরূদ পাঠ করলে সাথে সাথে তা আমার নিকট পৌঁছে দেয়া হয়। রাবী আবুদ্দরদা (রা.) বলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার ইন্তেকালের পরেও কি তা হবে? জবাবে প্রিয় নবী (স.) বললেন, আল্লাহ তায়ালা জমিনের জন্য নবীগণের দেহ নষ্ট করাকে হারাম করে দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহর নবী জীবিত। তাকে রিজিক প্রদান করা হয়।
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: যে ব্যক্তি আমার কবরের কাছে এসে দরূদ পাঠ করে আমি তা স্বয়ং শুনি আর দূর থেকে যে দরূদ পাঠ করে তা আমার নিকটে পৌঁছানো হয়। (বায়হাকী)
আর এক হাদীসে আছে: আমার ইন্তেকালের পরেও আমার জ্ঞান জীবন কালীন জ্ঞানের মত। যে ব্যক্তি আমার উপর দরূদ পাঠ করবে ফেরেশতা তার নাম ও বংশ পরিচয়সহ তা আমার কাছে পেশ করবে। (বায়হাকী)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসয়ুদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: মহানবী (স.) বলেছেন: আমার জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণকর। কারণ তোমরা আমার সঙ্গে কথা বলতে পারছ, আমি তোমাদেরকে বিধি-নিষেধগুলো বলে দিচ্ছি। আর আমার মৃত্যুও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। কেননা আমার মৃত্যুর পর তোমাদের আমলসমূহ আমার নিকট পেশ করা হবে। তার মধ্যে কল্যাণকর কিছু দেখলে আল্লাহর প্রশংসা করব। আর মন্দ আমল দেখলে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করব।
হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়িব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: এমন কোন দিন নেই যে দিন সকাল বিকাল মহানবী (স.) এর দরবারে উম্মতের আমলনামা পেশ করা না হয়, তিনি তাদের নাম ও আমল চিনতে, জানতে পারেন। আর এজন্যই তিনি আল্লাহর দরবারে কিয়ামতের বিচারে সাক্ষী হবেন। (অসমাপ্ত)
বেহেস্তের মাটি নূরান্বিত। সেই বেহেস্তের একটি টুকরা মদীনা মুনওয়ারার মসজিদে নববী ও প্রিয় নবী (স.) এর কবর মোবারক আজ যেখানে অবস্থিত সেখানে অর্থাৎ কবর শরীফ থেকে নবী (স.) মিম্বর পর্যন্ত স্থানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্থাপন করে দেন, যা “রিয়াদুল জান্নাহ” নামে পরিচিত।
শেফাউস সুদূর, ওফা, শরহে মাওয়াহেবে জোরকানী, লদুন্নীতে কাবুল আহবার (রা.) এর বরাতে এভাবে বর্ণিত আছে: আল্লাহ পাক যখন নূরে মোহাম্মদীকে মাটির সাথে মিলাতে ইচ্ছে করলেন তখন জিবরাঈল (আ.) কে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে মাটি নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। জিবরাঈল (আ.) একদল ফেরেশতাসহ এসে মদীনা মুনাওয়ারায় যেখানে এখন নবীজীর কবর মোবারক সেখান থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে গেলেন। নূরে মুহাম্মদীকে মিলান হলো সেই মাটির সাথে। অর্থাৎ, যে স্থানের মাটি থেকে সৃষ্টি, সেখানেই তাঁর শেষ শয়ন, সেখানেই তাঁর অবস্থান, রওজা-কবর এবং সেখান থেকেই হাশর ময়দানে উত্থান।
মদীনা মুনাওয়ারার গুরুত্ব ও মর্যাদা
তিনটি শহরের গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। মক্কা, মদীনা ও জেরুজালেম। মক্কার বিশেষ গুরুত্ব ক্বাবা শরীফের জন্য, মদীনার গুরুত্ব রওজা শরীফ ও মসজিদে নববীর জন্য, জেরুজালেমের গুরুত্ব মসজিদুল আকসা ও আম্বিয়ায়ে কিরামের স্মৃতির জন্য।
মদীনার নাম ছিল ইয়াসরিব। নবীজীর হিজরতের ফলে এর নাম হয় মদীনাতুন্নবী- মদীনা মুনাওয়ারা- নবীর শহর, নূরান্বিত শহর। হিজরতের পর থেকে ইন্তেকালের সময় পর্যন্ত এখানেই বসবাস করেছেন দয়াল নবী। এটাই হয় ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী। এখান থেকে ইসলামের আলো ছড়িয়ে যায় সারা দুনিয়ায়। নবীজীর জন্যই এ শহরের প্রতি প্রতিটি মুসলমানের সীমাহীন আকর্ষণ, ভালবাসা।
প্রিয় নবী (স.) মদীনায়ে তায়্যেবার মর্যাদা সম্পর্কে বলেন, ইন্নামা তায়্যেবাতুন তুনফি জ্জুন্নুবা কামা ইউন্ফিল কিরু খবসাল হাদীদ। অর্থাৎ- মদীনা শরীফ পূত পবিত্র। গুনাহ্সমূহের ময়লা-কালিমা সে এমনভাবে নির্মল করে দেয় যেমন কামারের হাফর দূর করে দেয় লোহার ময়লা। (বুখারী)।
প্রিয় নবী (স.) প্রায়সময় মদীনা শরীফের কল্যাণ ও বরকতের জন্য দোয়া করতেন। এই দোয়ার মধ্যে তিনি এও বলতেন: “হে আল্লাহ, ইবরাহীম (আ.) আপনার বান্দা, বন্ধু ও নবী। আমিও আপনার বান্দা ও নবী। তিনি মক্কার জন্য আপনার নিকট দোয়া করেছেন, আমিও তেমনি আপনার নিকট মদীনার জন্য দোয়া করছি।”
রাসূলে পাক (স.) বলেছেন: “মদীনা আমার হিজরতের স্থান, এখানে আমার শয়ন কক্ষ, এখান থেকেই আমি হাশর ময়দানে উত্থিত হব। দিন-রাত সত্তর হাজার ফেরেশতা এখানে হাজির থাকেন।”
এই মদীনায়ে তায়্যেবার প্রতি আশেকে রাসূলদের কত গভীর ভালবাসা, কত হৃদয়ের টান, কত দুর্নিবার আকর্ষণ, কত আবেগ-উচ্ছ্বাস, কোন ভাষা দিয়েই তা বর্ণনা করা যাবে না। ১৫শ’ বছর ধরে কত কবিতা, কত গজল-কাসিদা রচনা করা হয়েছে, কত লেখক ভক্তিগাঁথা শ্রদ্ধাঞ্জলি দুনিয়ার বিভিন্ন ভাষায় নিবেদন করেছেন তার হিসাব-নিকাশ কেউ করতে পারবে না। এই শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের ধারাবাহিকতা চলছে, চলবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত। বিদ্বেষীরা যতই জ্বলে-পুড়ে মরুক, এই উত্তাল জোয়ারে কখনো ভাটা লাগবে না। মদীনা মুনাওয়ারায় রওজা মোবারক যিয়ারতে যাত্রাকে-সফরকে, যিয়ারতকে যতই নিরুৎসাহিত করা হোক তাতে পুণ্যার্থীদের ঢল একটুও কমবে না। দূর দেশে বসেও প্রেমিকদের আকুতি ধ্বনিত-রণিত হতে থাকবে।
পূবাল হাওয়া পশ্চিমে যাও বইয়া / যাওরে বইয়া এই গরীবের সালাম খানি লইয়া।
কিংবা- প্রিয় নবীর যিয়ারতে চলরে মদীনায় / দুনিয়ার জান্নাত গো গুলজারে মদীনা।
ইয়া নবী ইয়া কামলিওয়ালা, তুমি মোরে লও ডেকে মদীনা।
তোমার বিচ্ছেদ অনলে/যায় গো আমার হৃদয় জ্বলে
আমি যে আর সইতে পারি না
তুমি আমায় লও ডেকে মদীনা।।
মহাকবি আব্দুর রহমান জামীর মত নবী প্রেমিকরা এই নিবেদন পেশ করতেই থাকবে : “ও নূর বদন বাহির করো খোলগো চাদর এমানী/ঐ চেহারা দেখে আমার ধন্য করি যেন্দেগানী।”
মসজিদে নববীতে এক রাকাত নামাজ পড়ার বিনিময়ে আল্লাহ পাক ৫০ হাজার রাকাত নামাজের সওয়াব দান করেন (এ নিয়ে বিভিন্ন রেওয়ায়েত রয়েছে)। কারণ তো এই, নবীজী এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন, এখানে নামাজ পড়েছেন। মক্কার হারাম এরিয়ার মত মদীনার একটি হারাম এরিয়া নির্ধারিত রয়েছে। কারণ তো এই, এই জনপদে নবীজী বসবাস করেছেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন বেহেস্তের একটি টুকরা এখানে স্থাপন করে দিয়েছেন। কারণ এই, বেহেস্তি জমিনের নূরান্বিত মাটিই নূরে মুহাম্মদীর সাথে সম্পৃক্ত করবেন, এখানেই তাঁর দরবার হবে, এখানেই তিনি ইন্তেকাল করবেন, এখানেই তাঁর দাফন হবে, কবর হবে, রওজা হবে। সব-ই আল্লাহর ইচ্ছা ও এরাদা, সব তাঁরই মহাপরিকল্পনা।
আল্লাহর হাবীব (স.) বলেন: “যে ব্যক্তি মদীনা শরীফে মৃত্যুবরণ করবে, আমি কিয়ামতের দিন তার সুপারিশকারী হব।” নবীজী আরো বলেছেন: “যে ব্যক্তির মদীনা শরীফে মৃত্যুবরণ করার মত সুযোগ আছে সে যেন মদীনাতেই মৃত্যুবরণ করে। আমি কিয়ামতের দিন তার জন্য সাক্ষ্য দিব এবং তার জন্য সুপারিশকারী হব।”
ইন্তেকালের পরেও নবীজী (স.) তাঁর কবর শরীফে জিন্দা আছেন
ইন্তেকালের পরে নবীজীকে কোন্ স্থানে দাফন করা হবে এ নিয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত প্রকাশ করছিলেন। তখন হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা.) বললেন: “আমি রাসূল (স.) কে বলতে শুনেছি, যেখানে নবীর ইন্তেকাল হয় সেখানেই তাঁকে দাফন করতে হয়।” তাঁর থেকে আরও বর্ণিত আছে: “যেখানে তাঁর রূহ কবজ হয়েছে সেখানেই তাঁকে দাফন কর। ওই পবিত্র জায়গা ব্যতীত তাঁর রূহ কবজ করা হয়নি।” এ সিদ্ধান্তের পর হযরত আবু তালহা (রা.) নবীজীর শয়নকৃত বিছানাটি উঠালেন। যেখানে তিনি ইন্তেকাল করেছেন, এরপর ওই বিছানার নিচেই তাঁর কবর খনন করা হয়।
কবর শরীফ তৈরি হয়ে গেলে নূরানী লাশ তার ভিতর রাখা হলো। লাশ রাখার জন্য হযরত আব্বাস, হযরত আলী, হযরত ফজল ও হযরত কাসাম (রা.) কবরে নামলেন। কাজ শেষে তিনজন উপরে উঠে এলেন। কেবল হযরত কাসাম (রা.) আরও কিছুক্ষণ কবরে থাকলেন। উঠে এসে তিনি বললেন, আমি দয়াল নবীর মোবারক ওষ্ঠদ্বয় নড়তে দেখে কান লাগিয়ে শুনতে পেলাম তিনি মৃদু আওয়াজে বলছিলেন, ইয়া রাব্বী হাবলি উম্মতী, উম্মতী।
হযরত মাওলানা শাহ্ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) তাঁর ‘জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব’ কিতাবে লিখেছেন এবং তাফসিরে কুরতুবিতেও রয়েছে: হযরত আলী (রাঃ) বর্ণনা করেন: রাসূল (স.)-এর ইন্তেকালের তিন দিন পর এক আরাবী মুসলমান এসে প্রিয় নবী (স.)-এর কবরে মাথা ঠেকিয়ে তাঁর কবর থেকে মাটি নিয়ে নিজ মাথায় ছিটাতে লাগলেন আর বিনয়ের সাথে বলতে লাগলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আল্লাহর কুরআন শুনিয়েছেন আমরা শুনেছি, আপনি আমাদেরকে শিখিয়েছেন আমরা শিখেছি। আল্লাহ পাক তার পবিত্র কুরআনে বলেছেন: ওয়ালাও আন্নাহুম যলাম… অর্থাৎ – ‘যারা নিজেদের প্রতি যুলুম করে… তারা আপনার নিকট এলে এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলে, আপনিও (হে রাসূল) তাদের জন্য ক্ষমা চাইলে তারা অবশ্যই আল্লাহকে পরম ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু রূপে পাবে।’ (সূরা নিসা, ৬৪ আয়াত) অর্থাৎ, আল্লাহ তাদের সব গুনাহ মাফ করে দিবেন। এ আয়াতটি তিলাওয়াত করে লোকটি বলতে লাগল: আমি আমার প্রতি জুলুম করেছি, গুনাহ করেছি, এখন আমি আপনার দরবারে হাজির হয়েছি। হযরত আলী (রা.) বলেন: তক্ষুণি রওজা শরীফ থেকে আওয়াজ এলো, ‘তোমাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে’। তাফসীরে ইবনে কাসীরে, কিতাবুল মুগনীতে এবং শরহে ছগিরেও ঘটনাটি বর্ণিত আছে।
হযরত আহমাদ কবীর রিফায়ী (রহ.) ছিলেন বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) এর ভাগিনা। হযরত বড়পীর (রহ.) ও রিফায়ী (রহ.) হজ করতে আসেন এবং হজের পরে রওজা শরীফ জিয়ারতে দাঁড়ান। তখন হযরত আহমাদ কবীর রিফায়ী আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলতে থাকেন: ‘ফী হালাতিল রোওদি রূহী কুনতু আরসিলুহা/তুকাব্বিলুল আরদা অহিয়া নায়িবাতী। ফাহজিহিল দৌলাতুল আশবাহ কাদ হাদারতু/ফামদুদ য়ামিনিকা কায় তাহযি বিহা শাফতী’। ওগো দয়াল নবী! আমি যখন অনেক দূরে নিজ দেশে ছিলাম তখন নিজ রূহকে পাঠিয়ে দিতাম আপনার পবিত্র রওজা চুম্বনের জন্য, সে চুম্বন করে যেতো। এখনতো আমি সশরীরে আপনার দরবারে উপস্থিত হয়েছি, তাই এখন মেহেরবাণী করে আপনার পবিত্র ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিন যেন আমি তা চুম্বন করে ধন্য হতে পারি। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে নবীজী তাঁর পবিত্র ডান হাতখানা কবর শরীফ থেকে বের করে বাড়িয়ে দিলেন, রিফায়ী (রহ.) আবেগভরে তা চুম্বন করে বেহুশ হয়ে পড়লেন। তখন রওজা শরীফে, মসজিদে ৯০ হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন।
নবীজী যে তাঁর কবর মোবারকে সশরীরে যিন্দা রয়েছেন তা ইয়াহুদী নাসারার বিশেষজ্ঞরাও বিশ্বাস করত। ৫৫৭ ঈসায়ী সালে সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গী (রহ.) এর শাসনকালে খৃস্টানদের একটি দল গোপন বৈঠক করে সিদ্ধান্ত করে, হযরত মুহাম্মদ (স.)-ই হচ্ছেন মুসলমানদের সাফল্য ও বিজয়ের উৎস। তাঁর লাশ যদি মদীনার রওজাপাক থেকে চুরি করে সরিয়ে এনে বিনষ্ট করে দেয়া যায় তবে মুসলমানদের পরাস্ত করা আর অসম্ভব হবে না। পরামর্শ অনুযায়ী তারা অতি ধূরন্দর দু’টি লোককে এজন্য নিযুক্ত করে তাদেরকে বিপুল অর্থ সম্পদ দিয়ে মদীনায় পাঠিয়ে দিল। লোক দুটি পাক্কা দরবেশ সেজে মদীনায় এসে রওজাপাকের অদূরে একটি বাড়ী ভাড়া নিয়ে গোপন অভিসন্ধি বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করল। তারা শহরের লোকদের মধ্যে প্রভুত দান-সদকা করতো তবে কখনো ওই হুজরা থেকে বের হতো না। এভাবে লোকদের মধ্যে তারা দানশীল কামেল দরবেশ হিসাবে পরিচিতি লাভ করলো। এদিকে সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গী পরপর তিনবার একই রাতে রাসূলুল্লাহ (স.) কে স্বপ্নযোগে দর্শন করলেন। প্রিয় নবী (স.) দুজন লোকের চেহারা সুস্পষ্ট রূপে দেখিয়ে সুলতানকে বললেন, এই জালেমদ্বয়ের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করো। স্বপ্ন দেখে সুলতান আঁতকে উঠলেন এবং প্রভাতেই মদীনা যাত্রার প্রস্তুতি নিলেন। সঙ্গে নিলেন অত্যন্ত দক্ষ বিশজন ঘোরসওয়ার সৈনিক এবং বিপুল অর্থ। অবিরাম ১৬ দিন পথ চলার পর তিনি মদীনায় এসে পৌঁছালেন এবং ঘোষণা দিলেন, তিনি মদীনাবাসীদের দান করবেন, সবাই যেন তাঁর নিকট এসে দান গ্রহণ করে, একজন লোকও যেন অনুপস্থিত না থাকে। রাজ-ফরমান অনুযায়ী মদীনার সকল লোক হাজির হল, দান গ্রহণ করতে লাগল কিন্তু সুলতান তাদের মধ্যে ওই দুষ্ট লোক দুটি, যাদের চেহারা নবীজী তাঁকে দেখিয়ে ছিলেন তাদেরকে দেখতে পেলেন না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, মদীনার সব লোকই কি এখানে এসেছে? কেউ কি বাকি নেই? লোকেরা আরজ করলো, হুজুর, সবাই-ই এসেছে কেবল দু’জন লোক ছাড়া, তারা ওলী আল্লাহ-দরবেশ। তারা হুজরা থেকে কখনো বের হন না। তিলাওয়াত ও ইবাদত বন্দেগীতেই সর্বদা মশগুল থাকেন। সুলতান বললেন, আমাকে ঐ হুজরায় তাদের নিকট নিয়ে চলুন, আমি তাদের সাথে সাক্ষাৎ করব। লোকজন নিয়ে সুলতান সেখানে হাজির হলেন এবং দেখতে পেলেন, তারা ঠিক সেই লোকই যাদেরকে প্রিয় নবী (স.) দেখিয়ে ছিলেন। সুলতানের মনে আর কোনই সন্দেহ রইল না। সুলতান তাদের সামনে কুরআন শরীফ খোলা অবস্থায় দেখলেন। সুলতান তাদেরকে বিছানা থেকে সরে আসার নির্দেশ দিলেন এবং মেঝেতে পাতা বিছানা তুলে ফেলে দেখতে পেলেন, সেখান থেকে একটি সুড়ঙ্গপথ রওজা শরীফের দিকে চলে গেছে। সেই সুড়ঙ্গপথে অগ্রসর হয়ে দেখলেন, সুড়ঙ্গটি প্রায় রওজার নিকটে পৌঁছে গেছে, আর দু’এক দিন খনন করলে কবর শরীফে নবীজীর দেহ মোবারক পর্যন্ত পৌঁছে যেত। পাপিষ্টদ্বয় দিনে ইবাদতের ভান করে কাটিয়ে দিত এবং গভীর রজনীতে সকলের নিদ্রামগ্ন অবস্থায় লাশ মোবারক সরিয়ে নেয়ার জন্য সুড়ঙ্গ খনন করত, আর খননকৃত মাটিগুলো বস্তায় ভরে পাহাড়ের ঢালে ফেলে দিয়ে আসত। ব্যাপার দেখে সকলে বিস্ময়ে, ভয়ে হতবাক! সুলতান তাদেরকে বন্দী করলেন, মৃত্যুদণ্ড দিলেন এবং তাদের লাশ জনসম্মুখে জ্বালিয়ে দিলেন। তিনি রওজা শরীফের চারপাশে মাটির গভীর থেকে সীসা ঢালাই করে মজবুত দেয়াল নির্মাণ করে এর সুরক্ষার ব্যবস্থা করলেন।
আর একটি ঘটনা
এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন তাবারী তাঁর ‘রিয়াজে নযরাহ’ কিতাবে। রাফেজী সম্প্রদায়ের কতিপয় দুর্বৃত্ত অনেক উপঢৌকন নিয়ে মদীনার আমীরের নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে প্রদান করল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত লোভী এবং ঐ সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরক্ত। তাঁর নিকট পাপিষ্টরা তাদের অভিপ্রায় প্রকাশ করল যে, তারা রওজা শরীফে ঢুকে সেখান থেকে হযরত আবু বকর (রা.) এবং হযরত ওমর (রা.) এর দেহ মোবারক সরিয়ে নিয়ে যাবে। তারা এ কাজে আমীরের অনুমতি ও সহায়তা কামনা করল। আমীর সম্মতি দিলেন এবং মসজিদে নববীর খাদেমকে নির্দেশ দিলেন, গভীর রাতে ঐ লোকগুলো হাজির হলে যেন দরজা খুলে দেয়া হয় এবং তাদের কাজে যেন বাঁধা না দেয়। নির্দেশ অমান্য করার কোন সাধ্য ছিল না খাদেমের। লোকজন এশার নামাজ পড়ে বিদায় হওয়ার পর ৪০ জন দুর্বৃত্ত শাবল কোদাল নিয়ে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করল এবং রওজা শরীফের দিকে পা বাড়াল। খাদেম এ দৃশ্য দেখছিলেন এবং নিরুপায় বসে কাঁদছিলেন। দুষ্কৃতকারীরা মসজিদে নববীর মিম্বর পর্যন্ত অগ্রসর হতে না হতেই হঠাৎ সবাই মাটির মধ্যে ধসে গিয়ে বিলীন হয়ে গেল।
আমীর প্রতীক্ষা করছিলেন তাদের জন্য। তারা ফিরে না আসায় খাদেমকে কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। খাদেম সব ঘটনা খুলে বললে তিনি গিয়ে ধসে যাওয়ার স্থান পরিদর্শন করলেন এবং ধসে যাওয়ার চিহ্ন প্রত্যক্ষ করলেন। ঘটনাটি অত্যন্ত মশহুর। তারিখে সাহমুতিসহ বিভিন্ন গ্রন্থে এর উল্লেখ আছে। (জববুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব)। এ ধরনের বিম্ময়কর ঘটনা বহু আছে, যদ্বারা রওজা শরীফে প্রিয় নবী (স.) যে সশরীরে জীবিত আছেন তার প্রমাণ মিলে।
নবীগণ কবর শরীফে যিন্দা এর দলীল
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, আম্বিয়ায়ে কেরাম নিজ নিজ কবরে যিন্দা আছেন এবং তাঁরা কবরে বসে নামাজ পড়েন। (বায়হাকী)।
প্রিয় নবী (স.) বলেন: মিরাজের রাতে আমি কুসাইবুল আহমার নামক স্থানে মূসা (আ.) এর কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম তিনি নামাজ পড়ছেন। (মুসলিম-নাসায়ী)।
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত: আম্বিয়ায়ে কেরামকে কবরে রাখার ৪০ দিন পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত তাঁরা আল্লাহর সম্মুখে নামাজরত থাকেন। (বায়হাকী)।
ইবনে মাজাহ শরীফে আছে: রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন: জুমার দিন তোমরা আমার উপর বেশি বেশি দরূদ পাঠ কর। এ দিনে ফেরেশতাগণ উপস্থিত হন। তোমাদের মধ্যে কেউ আমার উপর দরূদ পাঠ করলে সাথে সাথে তা আমার নিকট পৌঁছে দেয়া হয়। রাবী আবুদ্দরদা (রা.) বলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার ইন্তেকালের পরেও কি তা হবে? জবাবে প্রিয় নবী (স.) বললেন, আল্লাহ তায়ালা জমিনের জন্য নবীগণের দেহ নষ্ট করাকে হারাম করে দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহর নবী জীবিত। তাকে রিজিক প্রদান করা হয়।
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: যে ব্যক্তি আমার কবরের কাছে এসে দরূদ পাঠ করে আমি তা স্বয়ং শুনি আর দূর থেকে যে দরূদ পাঠ করে তা আমার নিকটে পৌঁছানো হয়। (বায়হাকী)
আর এক হাদীসে আছে: আমার ইন্তেকালের পরেও আমার জ্ঞান জীবন কালীন জ্ঞানের মত। যে ব্যক্তি আমার উপর দরূদ পাঠ করবে ফেরেশতা তার নাম ও বংশ পরিচয়সহ তা আমার কাছে পেশ করবে। (বায়হাকী)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসয়ুদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: মহানবী (স.) বলেছেন: আমার জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণকর। কারণ তোমরা আমার সঙ্গে কথা বলতে পারছ, আমি তোমাদেরকে বিধি-নিষেধগুলো বলে দিচ্ছি। আর আমার মৃত্যুও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। কেননা আমার মৃত্যুর পর তোমাদের আমলসমূহ আমার নিকট পেশ করা হবে। তার মধ্যে কল্যাণকর কিছু দেখলে আল্লাহর প্রশংসা করব। আর মন্দ আমল দেখলে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করব।
হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়িব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: এমন কোন দিন নেই যে দিন সকাল বিকাল মহানবী (স.) এর দরবারে উম্মতের আমলনামা পেশ করা না হয়, তিনি তাদের নাম ও আমল চিনতে, জানতে পারেন। আর এজন্যই তিনি আল্লাহর দরবারে কিয়ামতের বিচারে সাক্ষী হবেন। (অসমাপ্ত)
দৈনিক ইনকিলাবের সৌজন্যে