বছরে ৩৯ হাজার ট্রান্সফরমার পুড়ছে
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
লোড পরীক্ষা ছাড়াই নির্বিচারে সংযোগ প্রদান। ফলে ওভারলোডেড হয়ে পড়ছে ট্রান্সফরমার। অভাব রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণেরও। মানের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে কেনা হচ্ছে সস্তায় ভারতীয় ট্রান্সফরমার। এসব কারণে হরহামেশাই ঘটছে ট্রান্সফরমার পুড়ে যাওয়ার ঘটনা। বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের হিসাবেই দেশের বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনে বছরে পুড়ছে ৩৮ হাজার ৮৭০টি ট্রান্সফরমার, যার আর্থিক ক্ষতি কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকা। অথচ মালয়েশিয়ায় গত তিন বছরে পুড়েছে মাত্র তিনটি ট্রান্সফরমার। অন্যান্য দেশে এ হার আরো কম।
ট্রান্সফরমার পুড়ে যাওয়া নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে পাওয়ার সেল। মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইন ঘুরে এসে সেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বিতরণ ব্যবস্থার তুলনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। দেশের বিতরণ ব্যবস্থার সার্বিক চিত্রই এসেছে তাতে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে গড়ে সাড়ে ৫ শতাংশ ট্রান্সফরমার পুড়ে যাচ্ছে। ফলে গুনতে হচ্ছে বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি।
তবে এ ক্ষতি এড়াতে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে শিগগিরই কয়েকটি নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে পাওয়ার সেলের পরিচালক আমজাদ হোসেন (কমার্শিয়াল) বণিক বার্তাকে বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার পুনঃস্থাপন করতে হবে। সম্পদের ব্যবস্থাপনায় বাড়াতে হবে নজরদারি। পরিস্থিতি উত্তরণে এ ধরনের বেশকিছু সুপারিশ বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
বিতরণ ব্যবস্থায় বর্তমানে ট্রান্সফরমারের সংখ্যা ৭ লাখ ১৫ হাজার। এর মধ্যে ওভারলোডেড অবস্থায় আছে ৮০ হাজার। লোড পরীক্ষা ছাড়া নির্বিচারে সংযোগ দেয়ার কারণেই ওভারলোডেড ট্রান্সফরমারের সংখ্যা বাড়ছে। গ্রাহকরাও অনেক সময় বিতরণ কোম্পানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না জানিয়ে বেশি লোড ব্যবহার করছেন। নিয়মিত ব্যবধানে ট্রান্সফরমারগুলো রক্ষণাবেক্ষণের কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। নিম্নমানের সিলিকা জেল ব্যবহার করায় তা ট্রান্সফরমারের সুরক্ষা দিতে পারছে না। মানসম্পন্ন ট্রান্সফরমার কেনার বিষয়টিও অবহেলা করা হচ্ছে। এসব কারণেই মূলত পুড়ে যাচ্ছে ট্রান্সফরমারগুলো। পাওয়ার সেলের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, শুধু গত আগস্টেই পুড়েছে ৪ হাজার ৪০টি ট্রান্সফরমার। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, এখানে ২০০ কিলোভোল্টের (কেভিএ) ট্রান্সফরমার ব্যবহার করা হয়। এ হিসাবে একটি ট্রান্সফরমারের আওতায় শহরে সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাহককে সংযোগ দেয়া যায়। কিন্তু এসব বিচার-বিবেচনা ছাড়াই বিদ্যুত্ সংযোগ দেয়া হচ্ছে। এতে ট্রান্সফরমারটি ওভারলোডেড হয়ে পড়ছে।
সূত্র জানায়, ওভারলোড সমস্যায় পড়ে বর্তমানে সংযোগ দিতে পারছে না বিতরণ কোম্পানিগুলো। পাঁচটি বিতরণ কোম্পানির কাছে জুলাই পর্যন্ত আবেদন পড়েছে ১৩ লাখ ৯৭ হাজার ৮৯৫টি। এর মধ্যে শীর্ষে আছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। এ প্রতিষ্ঠানের কাছেই আবেদন পড়েছে ১০ লাখ ৫০ হাজার ৯৪১টি। আরইবির ৭০টি সমিতির মধ্যে অনেক এলাকায় সংযোগ প্রদান পুরোপুরি বন্ধ আছে। ওভারলোড কমাতে নতুন প্রকল্প শুরু করেছে তারা।
আরইবি সূত্র জানায়, ৭৩ হাজার ৬৭৮টি ট্রান্সফরমার বর্তমানে ওভারলোডেড। এসব ট্রান্সফরমারের কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। একই কারণে এগুলো জ্বলে যাওয়া, লাইন পুড়ে ও ছিঁড়ে যাওয়াসহ উপকেন্দ্র বিকল হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। তবে ৩৭টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে এরই মধ্যে ‘আপগ্রেডেশন অব রুরাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
আরইবির সদস্য (প্রকৌশল) মো. নুরুল আবসার এ প্রসঙ্গে বলেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্পের বিভিন্ন কাজ এগিয়ে চলছে। এটি বাস্তবায়ন হলে সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। পাশাপাশি লোডশেডিং ও সিস্টেম লস কমে আসবে। নতুন সংযোগ দেয়াও সম্ভব হবে।
সূত্রমতে, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ৫ হাজার ৬৭৯টি ট্রান্সফরমারের মধ্যে ওভারলোডেড ৬২টি। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ট্রান্সফরমার রয়েছে ১৮ হাজার ৮৬৪টি। এর মধ্যে ওভারলোডেড অবস্থায় রয়েছে ২ হাজার ৩৭টি। তবে নতুন ট্রান্সফরমার কেনা ও প্রতিস্থাপনের কাজ করছে পিডিবি। এছাড়া ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) ৫ হাজার ৭৮৬টি ট্রান্সফরমারের মধ্যে ওভারলোডেড চারটি। সক্ষমতা বাড়িয়ে সংযোগ দেয়ার প্রক্রিয়া নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। রাজধানীর বৃহৎ বিতরণ কোম্পানি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ৯ হাজার ৭০৩টি ট্রান্সফরমারের মধ্যে ওভারলোডেড ৭০২টি।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বলেন, আগে কোরিয়া-জাপান থেকে ট্রান্সফরমার কেনা হতো। এখন ভারত থেকে সস্তায় কেনা হচ্ছে। এছাড়া নির্বিচারে সংযোগ প্রদান করে ওভারলোড সমস্যা বাড়ানো হয়েছে। এসবের খেসারত হিসেবে এখন বছরে শত শত কোটি টাকার ট্রান্সফরমার পুড়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, পাঁচ বছরে দেশে বিদ্যুৎ উত্পাদনক্ষমতা বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। একই সময়ে উত্পাদন বেড়েছে ৬২ শতাংশ। অথচ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন বেড়েছে যথাক্রমে ১৭ ও ১১ শতাংশ। তাই উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।