এনবিআরের অনুসন্ধান
আমদানি পণ্যের ৩০% চালানেই রাজস্ব ফাঁকি
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ
অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক ::
আমদানি পণ্যের ৩০ শতাংশ চালানেই মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়। এজন্য এইচএস কোড পরিবর্তন, শুল্ক মূল্যে অসামঞ্জস্যতা, পণ্যের নাম পরিবর্তনসহ বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা হয়। পোশাক শিল্প ও এর প্রচ্ছন্ন রফতানিকারকদের মধ্যেই এ প্রবণতা বেশি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সব কাস্টমস কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে রাজস্ব বোর্ড।
এনবিআরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, আমদানিকৃত কাঁচামালের অনুমোদন নিতে ব্যবহৃত সনদেই (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন, পারমিশন) অসত্য তথ্য দিতে সহযোগিতা করেন সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা। দেশের বিভিন্ন বন্দরে আমদানিকৃত পণ্য বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কিছু কর্মকর্তা, শিপিং-সিঅ্যান্ডএফ, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং এজেন্টদের সঙ্গে যোগসাজশে কাস্টমস শুল্কায়ন ও প্রদেয় শুল্ক প্রদান না করে এবং বিদ্যমান অন্যান্য আইন প্রতিপালন না করে গোপনে বন্দর থেকে পণ্য পাচার করে। এভাবে ৩০ শতাংশ চালানেই রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়। মূলত মংলা, বেনাপোল, আইসিডিসহ ঢাকা বিমানবন্দরের ফ্রেইট ইউনিট দিয়ে আমদানির ক্ষেত্রে চালানে শুল্ক ফাঁকি বেশি হচ্ছে।
এনবিআর সদস্য (শুল্ক) খন্দকার মোহাম্মদ আমিনুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে আমরা সবসময়ই সতর্ক আছি। এ বিষয়ে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে, যাতে কেউ শুল্ক ফাঁকির সুযোগ না পায়।’
খাতভিত্তিক হিসাবে পোশাক ও এর প্রচ্ছন্ন রফতানি শিল্পেই এ ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। পোশাক শিল্পের প্রচ্ছন্ন রফতানিকারকদের মধ্যে আছে সুতা, কাপড়, প্লাস্টিক হ্যাঙ্গার, পলিব্যাগ, বোতাম, কার্টন প্রস্তুতকারক। পোশাক প্রস্তুতকারকদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবেই এসব পণ্য প্রচ্ছন্ন বা পরোক্ষভাবে রফতানি করেন পণ্যের প্রস্তুতকারকরা। আর রফতানির উদ্দেশ্যে বন্ড সুবিধার আওতায় অসত্য তথ্য দিয়ে প্রচ্ছন্ন রফতানিকারকরাই অনিয়ম বেশি করছে বলে এনবিআরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। রাজস্ব ফাঁকির এ প্রবণতা রোধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ায় এনবিআর আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিজিএমইএ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শহীদুল্লাহ আজীম বলেন, খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা সে যে-ই হোক না কেন, তাদের রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা সংগঠন সমর্থন করে না। আর এ ধরনের প্রবণতা কমিয়ে আনতে সংগঠন থেকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন দেয়ার উদ্যোগও বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে সক্রিয় কারখানার ৮০ শতাংশ তা বাস্তবায়ন করেছে।
তিনি আরো বলেন, এনবিআরকে অনুরোধ করব, এ ধরনের কোনো ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেলে তারা যেন যথাযথ পদক্ষেপ নেয়, প্রয়োজন হলে যেন বন্ড লাইসেন্সও বাতিল করে।
জানা যায়, গত তিন অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৩ হাজার কোটি ডলার। যার মধ্যে পোশাক ও এ
শিল্পের প্রচ্ছন্ন রফতানিকারকদের আমদানিকৃত পণ্য ডায়িং, ট্যানিং, প্লাস্টিক, র-কটন, ইয়ার্ন, টেক্সটাইল আমদানি হয়েছে প্রায় ৮৫০ কোটি ডলারের। এনবিআরের অনুসন্ধান অনুযায়ী এসব পণ্য আমদানির চালানেই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ঘটছে।
এনবিআরের অনুসন্ধান বলছে, প্রচ্ছন্ন বন্ড পদ্ধতিতে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রায় দুই লাখ টন প্লাস্টিক উপকরণ আমদানি হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ১ দশমিক ৩৩ লাখ টন। ক্ষেত্রবিশেষে কারখানার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো না থাকা সত্ত্বেও বন্ড সুবিধায় বিপুল পরিমাণ আমদানি হয়েছে। যদিও এ পরিমাণ পণ্য দেশের রফতানি শিল্পে প্রয়োজন ও ব্যবহার হয় না।
অভিযোগ উঠেছে, কখনো মিথ্যা তথ্যের ওপর বন্ড লাইসেন্স, মিথ্যা রফতানি ঋণপত্রের ওপর ইউডি প্রদান, মিথ্যা কনজাম্পশন তথ্যের ওপর ইউডি প্রদান, জাল লাইসেন্সসহ বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ঘটছে। শুল্ক গোয়েন্দাদের সতর্ক করা হলেও তারা পরিস্থিতি উত্তরণে তেমন কোনো নজরদারি দিচ্ছেন না। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ— অসাধু ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় মূলত অসাধু সরকারি কর্মকর্তারাও রাজস্ব ফাঁকির ঘটনায় জড়িত।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সহসভাপতি কেএম ইকবাল হোসেন বলেন, ‘প্রচ্ছন্ন রফতানিকারকদের মধ্যে যারা অসত্, তারাই এ ধরনের অনিয়ম করছেন। তবে এদের মধ্যে ভালো ব্যবসায়ীও আছেন, যারা নিগৃহীত। এ ধরনের প্রবণতা রোধে ব্যবসায়ী ও এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা ও কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।’
সম্প্রতি রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে এনবিআরের শুল্কনীতি ও বাজেট বিভাগের এক চিঠিতে সব মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কমিশনার এবং ডিজি শুল্ক গোয়েন্দাদের পেশাগত মনোভাব, সমন্বিত ও সম্মিলিত উদ্যোগ নিয়ে আধুনিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার নিরিখে না দেখার কারণেই সামগ্রিক কাস্টমস ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন অনিয়ম মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে ফাঁকির ঘটনার মাধ্যমে নির্ধারিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সমস্যা হচ্ছে। যৌক্তিক কারণ না থাকা সত্ত্বেও এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে পণ্য চালান চলে যাচ্ছে। একই বিষয়ে বিভিন্ন দফতর বিভিন্ন কার্যক্রম নেয়ায় যথাযথ রাজস্ব আদায়, সুষম প্রতিযোগিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এটা চলতে দেয়া যায় না। অনেক কর্মকর্তার কাস্টমস বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই বলেও এ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুল্কে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার ৭২০ কোটি টাকা।