১৫শ কোটি টাকায় দুটি সাবমেরিন আসছে চীন থেকে
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
জন্য দেড় হাজার কোটি টাকা দিয়ে দুটি ডুবো যুদ্ধজাহাজ (সাবমেরিন) কেনার জন্য চীনের সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। ২৪ বছরের পুরোনো এই সাবমেরিন দুটি বর্তমানে চীনের নৌবাহিনী ব্যবহার করছে। পুনঃসজ্জিত করার পর ২০১৮ সালের মধ্যে এগুলো বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যুক্ত হবে বলে নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা আশা করছেন।
নৌবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, মোট চারটি সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনা আছে সরকারের, যাতে বাহিনীতে একটি ‘সাবমেরিন স্কোয়াড্রন’ গঠন করা যায়। সাবমেরিন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি পৃথক বিভাগ (সাবমেরিন অপারেটিং অথরিটি) গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রিয়ার অ্যাডমিরাল পদের একজন কর্মকর্তা এ বিভাগের প্রধান হবেন। সাবমেরিন পরিচালনার জন্য জনবল লাগবে প্রায় ২০০, যাঁদের বেশ কয়েকজনকে ইতিমধ্যে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্রয় কমিটির এক সদস্য জানান, চুক্তি অনুসারে ‘০৩৫জি’ মডেলের দুটি সাবমেরিন সরবরাহ করবে চীন। ২০১৩-১৪ থেকে শুরু করে পরবর্তী পাঁচ বছরে (২০১৭-১৮) এর দাম পরিশোধ করা হবে। এর মূল্য ধরা হয়েছে ২০ কোটি ৩৩ লাখ ডলার বা এক হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশের নৌবাহিনীর জন্য সাবমেরিন কতটা জরুরি, জানতে চাইলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, সাবমেরিন কেনার সিদ্ধান্ত হয় মহাজোট সরকারের সময়। এবার নতুন সরকার আসার পর সংসদীয় কমিটি মাত্র একটি সভা করেছে। সে সময় সাবমেরিন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলেও জানান।
পুরোনো এই সাবমেরিন দুটির আয়ুষ্কাল আর কত সময় আছে, বছরে এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচই বা কত হবে, সাবমেরিন সংযোজনের ফলে নৌবাহিনীর শক্তিই বা কত বাড়বে—এসব জিজ্ঞাসার কোনো জবাব আপাতত মেলেনি নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছ থেকে।
ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের কোনো প্রতিরক্ষানীতি নেই। ফলে কিসের ওপর ভিত্তি করে এ ধরনের বড় কেনাকাটা করা হচ্ছে, তা পরিষ্কার করা দরকার। এসব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা খুবই জরুরি।’
এই সাবমেরিন কেনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা সরাসরি সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। গত ৬ এপ্রিল সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের কাছে এ ব্যাপারে তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় প্রথম আলো। দেড় মাস পরে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের একজন কর্মকর্তা ফোন করে জানান, এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়।
পরে নৌবাহিনীর সদর দপ্তরে তথ্য চেয়ে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হয়। তারাও কোনো তথ্য দেয়নি। তবে নৌবাহিনীর দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা সাবমেরিন কেনা নিয়ে জেনস ডিফেন্স উইকলিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের ফটোকপি এই প্রতিবেদকের হাতে তুলে দেন। প্রতিরক্ষাবিষয়ক এই সাময়িকী যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত হয়।
জেনস ডিফেন্স উইকলির ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‘টাইপ-০৩৫জি’ মডেলের সাবমেরিন তৈরি শুরু হয় ১৯৮৫ সালে। আর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে। পাঁচ হাজার ২০০ অশ্বশক্তির ইলেক্ট্রো ডিজেল ইঞ্জিনের এসব সাবমেরিনে পানি থেকে পানিতে বা পানির ওপরে নিক্ষেপণযোগ্য স্বয়ংক্রিয় ক্ষেপণাস্ত্র (টর্পেডো), মাইন ও উন্নত প্রযুক্তির রাডার আছে। আরও আছে ফ্রান্সে তৈরি পানির তলদেশে শব্দ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তল্লাশি চালানোর ব্যবস্থা (সোনার সিস্টেম)। এতে ৫৭ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর আবাসনসুবিধা আছে। এগুলো ৩০০ মিটার (৯৮৫ ফুট) পর্যন্ত পানির গভীরে যেতে পারে।
জেনস ডিফেন্স উইকলির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চীনে এ ধরনের একটি সাবমেরিনের ভেতরে ২০০৩ সালের এপ্রিলে বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। এতে আক্রান্ত হয়ে ৭০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী মারা যান। এক বছর পর সেটি মেরামত করে আবার চালু করা হয়।
এ ধরনের একটি নতুন সাবমেরিনের দাম কত, জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, চীন সরকারের আন্তরিকতার কারণেই বাংলাদেশ এত কম মূল্যে সাবমেরিন পাচ্ছে। এ ধরনের নতুন একটি সাবমেরিনের মূল্য ১০০ কোটি ডলার পর্যন্ত হয়। নতুন একটি সাবমেরিনের গড় আয়ু ধরা হয় ২৫ বছর। তবে পুনঃসজ্জিত করে আয়ু বাড়ানো যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নৌবাহিনীর একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, নৌবাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে ১০ বছরের একটি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। তার অংশ হিসেবে সাবমেরিন কেনা হচ্ছে। তা ছাড়া সাবমেরিন পরিচালনার উপযোগী কর্মকর্তা তৈরি করতে অনেক সময় লাগে। এ কারণে এখন থেকেই কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে নৌবাহিনীর বেশ কিছু কর্মকর্তা তুরস্কের গোল চুক নৌঘাঁটিতে সাবমেরিন পরিচালনার ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
সূত্রটি জানায়, সাবমেরিনের ঘাঁটি হবে কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার কুতুবদিয়া চ্যানেলে। এ জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কাছে প্রায় ৪২০ একর জমি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটার অদূরে রাবনাবাদ চ্যানেলের কাছে আরেকটি ঘাঁটি তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে সাবমেরিন নোঙর করার (বার্থিং) সুবিধা থাকবে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এ ঘাঁটি প্রস্তুত না হলে নৌবাহিনীর চট্টগ্রাম ঘাঁটিতে এসব সাবমেরিন থাকতে পারবে বলে নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, সাবমেরিন কেনার ব্যাপারে চীনের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ২০০৫ অর্থবছরে সরকার প্রথম একটি সাবমেরিন কেনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১০ সালে চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক থেকে পুরোনো সাবমেরিন কেনার চেষ্টা চালায়। কিন্তু চীন ছাড়া এ ব্যাপারে আর কারও কাছ থেকে সাড়া মেলে না। চীনের আমন্ত্রণে সরকারের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সে দেশ সফর করে। দলটি সাবমেরিন পরিদর্শন করে তা কেনার পক্ষে মত দেয়। এরপর চীন দুই দেশের সরকার পর্যায়ে দুটি সাবমেরিন বিক্রির প্রস্তাব করে। চীনের সাবমেরিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘পলি টেক ইনকরপোরেট’-এর ১৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলও ঢাকা সফর করে। এরপর দুই দেশের মধ্যে এ-সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির জন্য নৌবাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ ও আইন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
জানতে চাইলে নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল আবু তাহের বলেন, বাহিনীকে সাজাতে হবে সামনের সময়কে বিবেচনায় নিয়ে। নৌবাহিনীর জন্য সাবমেরিন কেনা অনেক দিনের প্রচেষ্টার ফল। এতে বাহিনীর মর্যাদা ও ক্ষমতা বাড়বে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে পরিণত হবে।