ষোড়শ সংবিধান সংশোধন বিল পাস
বিচারকদের অভিশংসন ক্ষমতা পেল সংসদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৪:৫৬ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল-২০১৪ গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ৪০ বছর পর সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ন্যস্ত হলো।
বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত¯ সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যদের বিপুল হর্ষধ্বনি এবং দফায় দফায় টেবিল চাপড়ানোর মধ্য দিয়ে বিলটি পাস হয়। এখন রাষ্ট্রপতি বিলটিতে সম্মতি জানিয়ে স্বাক্ষর করলে তা সংবিধানের অংশ হবে।
বিল পাসের সময় সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টি-জেপির সভাপতি, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন সংসদে উপস্থিত ছিলেন না।
বিল-সম্পর্কিত আলোচনায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অঙ্গীকার করে বলেন, শেখ হাসিনার সরকার সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারকদের নিয়োগ বিধিমালা নিশ্চয়ই করবে।
রাত সাতটা ৪০ মিনিটে আইনমন্ত্রী বিলটি বিবেচনায় নেওয়ার জন্য স্পিকারের অনুমতি প্রার্থনা করেন। এরপর বিলের ওপর দেওয়া নোটিশ নিষ্পত্তি শেষে রাত ১১টা নয় মিনিটে তা বিভক্তি ভোটে পাস হয়। বিলের পক্ষে ভোট পড়ে ৩২৭টি, বিপক্ষে কোনো ভোট পড়েনি। এর আগে বিলের দফা ও সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর বিভক্তি ভোট হয়। তা ৩২৮-০ ভোটে পাস হয়। বিলটি পাস হতে সময় লেগেছে মোট তিন ঘণ্টা ৩১ মিনিট। ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হতে সময় লেগেছিল তিন ঘণ্টা পাঁচ মিনিট।
বিলটি পাসের আগে বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়। জনমত যাচাইয়ের বিষয়টি ভোটে দেওয়া হলে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদসহ নোটিশদাতাদের অনেকেই তাঁদের নোটিশের বিপক্ষে ভোট দেন। এ নিয়ে সরকারি দলের সাংসদেরা কিছুক্ষণ হাসাহাসিও করেন।
গতকাল বিল নিয়ে আলোচনার সময় রাত সাড়ে আটটায় হঠাৎ করে সংসদের শব্দযন্ত্র বিকল হয়ে যায়। পরে ঠিক হলেও সব মাইক কার্যকর ছিল না। যে কারণে অনেকের বক্তব্য স্পষ্ট শোনা যায়নি।
৭ সেপ্টেম্বর আইনমন্ত্রী বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন। পরে তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল।
পাস হওয়া বিলে ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে দফা ২-এ বলা হয়েছে, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠ সদস্যের প্রস্তাবক্রমে রাষ্ট্রপতির আদেশে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণ করা যাবে।
৩ দফায় বলা হয়েছে, সাংসদদের প্রস্তাব-সম্পর্কিত এবং বিচারকের অসদাচরণ ও অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ৪ দফায় বলা হয়েছে, কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করতে পারবেন।
এর আগে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত হয়েছিল। এরপর সামরিক ফরমানের দ্বারা পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়। প্রধান বিচারপতি ও অপর দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নিয়ে জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়।
২০১২ সালে সড়ক ভবনকে কেন্দ্র করে আদালতের একটি রায় নিয়ে সংসদে বিরূপ সমালোচনা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে একজন বিচারক সংসদ ও স্পিকারকে নিয়ে মন্তব্য করলে সেই সময় সাংসদদের অনেকেই বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনার দাবি তোলেন। এ নিয়ে স্পিকার পরে একটি রুলিংও দেন।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণসংবলিত বিবৃতিতে আইনমন্ত্রী বলেন, বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে। আইন অনুযায়ী অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো বিচারককে অপসারণ করা যাবে না। বিলটি আইনে পরিণত হলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে।
বিলের ওপর আলোচনা: বিলের ওপর জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, মহাসচিব জিয়াউদ্দীন আহমেদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, এম এ হান্নান, ইয়াহইয়া চৌধুরী, রওশন আরা মান্নান, নুরুল ইসলাম, জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল, বিএনএফের আবুল কালাম আজাদ, স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী, হাজি মো. সেলিম, তাহজীব আলম সিদ্দিকী ও আবদুল মতিন।
বিলটি বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেন স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী, হাজি মো. সেলিম, তাহজীব আলম সিদ্দিকী, আবদুল মতিন, জাতীয় পার্টির এম এ হান্নান, ইয়াহইয়া চৌধুরী ও রওশন আরা মান্নান এবং বিএনএফের আবুল কালাম আজাদ।
এ-সম্পর্কিত আলোচনায় বেশির ভাগ সদস্য বলেন, বিলটি তড়িঘড়ি করে আনা হয়েছে। তাই এ বিষয়ে জনমত নেওয়া দরকার। রওশন এরশাদ বলেন, যাঁরা সংবিধানে এই অনুচ্ছেদটি জুড়েছিলেন, তাঁরাই এখন এর বিরোধিতা করছেন। জনমনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আগেই বিচারপতি নিয়োগের আইন করা হলে ঝামেলা কমে যেত।
এইচ এম এরশাদ তাঁর প্রস্তাবের ওপর আলোচনা শুরু করার পরপরই শব্দযন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এ সময় সাংসদদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা অপেক্ষা করুন। ওরা দেখছে।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের দিকে তাকিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আজ সংবিধান সংশোধন বিল পাস হচ্ছে। তোমরা এগুলো দেখবে না!’
তখন সংসদ সচিবালয়ের সচিব আশরাফুল মকবুল নিজের আসন ছেড়ে অধিবেশনকক্ষের বাইরে চলে যান। পাঁচ মিনিট পর শব্দযন্ত্র আংশিকভাবে ঠিক হলেও সব মাইক কাজ করেনি। ফলে শেষ পর্যন্ত কারও বক্তব্য স্পষ্ট শোনা যায়নি।
এরশাদ শুরুতে বলেন, ‘বিলটিকে সঠিক বললে গৃহপালিত হয়ে যাই। মানি না, মানব না বলে যদি ওয়াকআউট করি, হরতাল করি, তাহলে সত্যিকার অর্থে বিরোধী দল হতে পারব। মধ্যরাতে টক শোতেও প্রশংসা পাব। কিন্তু মধ্যরাতে কে কী বলল, আমরা সেটা ভাবি না। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, সংবিধানের পক্ষে, সেই অনুযায়ী কাজ করি। তার পরও এটি একটি স্পর্শকাতর বিল। কথা হচ্ছে, এ বিলটি পাস হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হবে কি না। এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা বেশি। আমরা মনে করি, এই ক্ষমতা সংসদের কাছে থাকা উচিত। তবে জনগণকে বিষয়টি জানানো উচিত।’
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করার পক্ষে নই। এক বালতি দুধে খারাপ কিছু পড়লে পুরো দুধই নষ্ট হয়ে যায়। বিচার বিভাগ নিশ্চয়ই অনুধাবন করবেন, আমরা তাঁদের রক্ষা করতে চাই। তাঁদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে চাই। বিলটি নিয়ে মন্ত্রিসভা ও সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। সুতরাং জনমত যাচাইয়ের প্রয়োজন নেই।’
বিলটির ওপর বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, সরকারের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ এবং স্বতন্ত্র ১৫ জন সদস্য মোট ৩০টি সংশোধনী প্রস্তাব দেন।
এর মধ্যে রুস্তম আলী ফরাজী বিচারকদের চাকরির বয়স ৭০ করার প্রস্তাব দেন। ফিরোজ রশীদ জুডিশিয়াল ইনভেস্টিগেশন কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেন।
ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা, মোস্তফা লুৎফুল্লাহ, শেখ হাফিজুর রহমান, টিপু সুলতান ও ইয়াসিন আলী, জাসদের শিরীন আখতার ও নাজমুল হক প্রধান এবং রুস্তম আলী ফরাজী বিচারক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়নের বিধান অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেন।
কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়।
শেষ পর্যন্ত স্পিকার বিলটি পাসের জন্য ভোটে দিলে প্রথমে তা কণ্ঠভোটে গ্রহণ করা হয়। পরে বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে সেটি পাস হয়। বিভক্তি ভোটের সময় সাংসদেরা তাঁদের আসন ছেড়ে ‘হ্যাঁ’ লবিতে গিয়ে নির্ধারিত ব্যালটে স্বাক্ষর দিয়ে ভোট দেন।