সাজা কমিয়ে সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের করা দুটি আপিল আংশিক মঞ্জুর করে এ রায় দেওয়া হয়।
প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ আজ বুধবার এ রায় দেন।
বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি হলেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ট্রাইব্যুনালে সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠিত ২০টি অভিযোগের মধ্যে আটটি প্রমাণিত হয়।
এই মামলায় আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের করা দুটি আপিলের ওপর শুনানি শেষে গত ১৬ এপ্রিল আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ রাখেন। এর ঠিক পাঁচ মাসের মাথায় আজ রায় ঘোষণা করা হলো।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে প্রকাশিত আপিল বিভাগের আজকের কার্যতালিকার ১ নম্বর ক্রমিকে এ রায় ঘোষণার জন্য রাখা হয়।
আজ সকাল ১০টা পাঁচ মিনিটে এজলাসে আসেন প্রধান বিচারপতিসহ বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি। সকাল ১০টা সাত মিনিটে রায় দেওয়া শুরু হয়। শেষ হয় ১০টা ১০ মিনিটে।
আপিলে ১০, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে ৬, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ৮ নম্বর অভিযোগের অংশবিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে সাঈদীকে খালাস দেওয়া হয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে ৭ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর এবং ৮ নম্বর অভিযোগের অংশবিশেষে তাঁকে ১২ বছর কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ।
আপিল: ট্রাইব্যুনালের রায়ে ২০টি অভিযোগের মধ্যে আটটিতে দোষী সাব্যস্ত হন সাঈদী। এর মধ্যে একাত্তরে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যার দায়ে আলাদা দুটি অভিযোগে তাঁকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়। ওই সাজা থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেছিলেন এই জামায়াত নেতা। আর রাষ্ট্রপক্ষ অন্য ছয়টি অভিযোগে সাজা চেয়ে আপিল করে, যেগুলোতে দোষী সাব্যস্ত হলেও ট্রাইব্যুনাল সাজা দেননি।
ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর গত বছরের ২৮ মার্চ দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ। তবে ওই সময় কাদের মোল্লার আপিল মামলা বিচারাধীন থাকায় সাঈদীর মামলার শুনানি শুরু হয়নি।
গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর সাঈদীর দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল মামলার কার্যক্রম শুরু হয়, যা ৫০ কার্যদিবসে গত ১৬ এপ্রিল দুই পক্ষের আপিলের শুনানি শেষে রায় অপেক্ষমাণ রাখা হয়।
আপিলে আসামিপক্ষ দাবি করে, ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। অথচ ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম তাঁর স্বামীকে হত্যার অভিযোগে ১৯৭২ সালে যে মামলা করেছিলেন, তার এজাহারে (এফআইআর) আসামি হিসেবে সাঈদীর নাম ছিল না। পরে পুলিশ ওই মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে, তাতেও সাঈদী আসামি ছিলেন না। ওই অভিযোগপত্রের অনুলিপি আসামিপক্ষ অতিরিক্ত নথি হিসেবে আপিল বিভাগে দাখিল করেছে।
আসামিপক্ষ আরও দাবি করে, একাত্তরে পিরোজপুরে দেলোয়ার হোসেন শিকদার নামের এক রাজাকার ছিলেন, রাষ্ট্রপক্ষ ওই রাজাকারের অপরাধকে সাঈদীর ঘাড়ে চাপাচ্ছে। আর বিসাবালী হত্যাকাণ্ডের দায়ে সাঈদীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। অথচ বিসাবালীর ভাই সুখরঞ্জনবালী রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হওয়া সত্ত্বেও আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে অপহরণ করা হয়।
পক্ষান্তরে রাষ্ট্রপক্ষের দাবি, ইব্রাহিম কুট্টি হত্যাসংক্রান্ত যে নথির কথা আসামিপক্ষ বলছে, তা জাল ও মিথ্যা। বরিশাল ও পিরোজপুরের জেলা জজ আদালতে ওই ধরনের কোনো নথির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। মামলার প্রয়োজনে আসামিপক্ষ ওই নথি তৈরি করেছে, এ জন্য সেগুলো বিবেচনা না করার আরজি জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। আর সুখরঞ্জনবালীকে অপহরণের ঘটনাও আসামিপক্ষের তৈরি করা। কারণ, ওই ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
ট্রাইব্যুনালের রায়: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন।
সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠিত ২০টি অভিযোগের মধ্যে আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এগুলো হলো: ৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগ।
এর মধ্যে ৮ ও ১০ নম্বর অভিযোগ হত্যার, ১৪ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ ধর্ষণের এবং ১৯ নম্বর অভিযোগ ধর্মান্তরিত করার। বাকিগুলো নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন এবং এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতার অভিযোগ।
অষ্টম অভিযোগ হলো, একাত্তরের ৮ মে ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা এবং পিরোজপুরের পারেরহাট এলাকায় হিন্দুদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ।
দশম অভিযোগ হলো, একাত্তরের ২ জুন বিসাবালীকে হত্যা এবং উমেদপুর হিন্দুপাড়ার ২৪টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ।
১৪ নম্বর অভিযোগ হলো, মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদী হোগলাবুনিয়ার হিন্দুপাড়ায় এক নারীকে ধর্ষণ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ।
সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৬ নম্বর অভিযোগ, তিন নারীকে অপহরণ করে আটকে রেখে ধর্ষণ।
ধর্মান্তরিত করার ১৯তম অভিযোগ অনুসারে, সাঈদী প্রভাব খাটিয়ে পারেরহাটসহ অন্য গ্রামের ১০০-১৫০ হিন্দুকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেন।
সাঈদীর বিরুদ্ধে ষষ্ঠ অভিযোগ, মাখনলাল সাহার ২২ সের স্বর্ণ লুটের, সপ্তম অভিযোগ, মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম সেলিমকে নির্যাতন ও তাঁর বাড়ি লুণ্ঠনের পর অগ্নিসংযোগ।
১১তম অভিযোগ, মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে হামলা ও লুণ্ঠন।
ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যার দায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের দুটি, ধর্মান্তরিত করার একটি এবং লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতনের তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত হলেও দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় অন্য অভিযোগগুলোতে আলাদা করে কোনো দণ্ড দেওয়া হয়নি।
সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠিত ১ থেকে ৫ এবং ৯, ১২, ১৩, ১৫, ১৭, ১৮ ও ২০ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এর মধ্যে গণহত্যার চারটি (২, ৪, ১২, ১৫), ধর্ষণের দুটি (১৭ ও ২০) ও হত্যার (১, ৫, ১৩ ও ১৮) চারটি অভিযোগ। বাকি দুটি অভিযোগ লুটপাটের।