রাজনগরে কেমন আছেন ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত নারী সদস্যগণ
প্রকাশিত হয়েছে : ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক ::
স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করণে ইউনিয়ন পরিষদে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের জন্যও পদ রাখা হয়েছে। ৩টি ওয়ার্ড নিয়ে একটি নারী সদস্য আসন। একটি ইউনিয়নে সংরক্ষিত ৩টি নারী আসন রয়েছে। এসব আসনে নারী সদস্যরা ভোট যুদ্ধে জয়ী হয়ে এলেও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও নির্বাচিত পুরুষ সদস্যের সঙ্গে নামতে হচ্ছে নতুন যুদ্ধে। অন্যদিকে তাদেরকে উটকো ঝামেলা হিসেবেই দেখেন ইউনিয়ন পলিষদের নির্বাচিত পুরুষরা। জনগণের জন্য ঘোষিত ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বণ্টনে চেয়ারম্যান ও পুরুষ সদস্যরা নিজেদের মতের প্রাধান্য এবং তা বণ্টন করলেও নারী সদস্যদেরকে তাদের ন্যায্য পাওনা দেওয়া হয়না। ফলে ৩ ওয়ার্ড নিয়ে নারী সদস্যদের যৎসামান্য পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদে নারীর ক্ষমতায়ন এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করছে। প্রবল বাধা ও সামাজিক প্রতিকূলতা থাকা সত্তেও ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত নারী সদস্যরা নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। শহর ঘেঁষা ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্যরা নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে সচেতন হলেও প্রত্যন্ত এলাকা থেকে নির্বাচিত নারী সদস্যরা তেমন একটা দক্ষ নন।
বাংলাদেশের মতো রক্ষনশীল সমাজে ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত নারী সদস্যরা এখনো ঘরমুখী। অনেক ক্ষেত্রে তারা স্বামী ছাড়া বের হতে পারেন না। স্বামীদের নিয়েই তাদের চলতে হয়। এ জন্য দেখা যায় নির্বাচিত নারীর মতামতের পরিবর্তে তাদের স্বামীদের মতই প্রাধান্য পায়। ফলে নারীর ক্ষতায়ন কতটুকু হচ্ছে এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আবার ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত নারী সদস্যগণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হওয়ায় স্বামীদের নিয়েই চলতে হয়। স্বামীরাই তাদের হয়ে চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের সঙ্গে কাজ চালিয়ে নেয়ার মতো অবিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে নির্বাচিত নারীদের ক্ষতায়ন নিয়ে রাজনগর ডিগ্রী কলেজের প্রভাষক শাহানারা রুভি, মহিলা ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মো. ইকবাল, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হোসনে আরা তালুকদারসহ নারী নিয়ে কাজ করেন এমন বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, ইউনিয়ন পরিষদে নারীদের কি ক্ষমতা বা কাজ রয়েছে তা তাদেরকে জানাতে হবে। প্রয়োজনে ৬ মাস বা বছরে ১ বার তাদের নিয়ে বসতে হবে। তাদের অভিজ্ঞতা এবং কর্মপরিধি বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। সেই সঙ্গে নির্বাচিত পূরুষ সদস্যরা কিভাবে মহিলা সদস্যদের গুরুত্ব দিবেন এ ব্যাপারে তাদেরকেও নজরে রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় কোন কমিটির নারী সদস্য যদি কোন কারণে পুরুষ সদস্যকে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকার করলে পুরুষ সদস্যও বলে থাকেন- ‘আপনি স্বাক্ষর না দিলেও চলবে’। এ ব্যাপারটি গভীর ভাবে দেখতে হবে।
এদিকে উপজেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮ইং মোতাবেক উপজেলা পরিষদে ৩ জন নারী সদস্য থাকার নিয়ম থাকলেও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সাড়ে ৪ বছর চলে গেলেও এখনো স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেয়নি। তবে আশার কথা হল উপজেলা পরিষদে নারী সদস্য অর্ন্তভূক্তির জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় থেকে ২৫-০৮-১৩ ইং তারিখের স্মারক নং- ৪৬.০৪৬.০১৮.০০.০০.০৩৬.২০১২.৯৪১ দ্বারা একটি পরিপত্রের জারি করা হয়েছে। এর আলোকে উপজেলা প্রশাসন থেকে ভোটরা সংখ্যা অনুপাতে ইউনিয়ন গুলো থেকে ৩ জন্য নারী সদস্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচনি এলাকা ভাগ করে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে পাঠনো হয়েছ। আশাকার যাচ্ছে নরীরা উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত হয়ে হয়ে এসে বড় পরিসরে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ পাবেন।
এছাড়াও নির্বাচিত নারী সদস্যগণ জানেন না সরকার ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত নারী সদস্যদের কি দায়িত্ব দিয়েছে এবং তাদের কর্তব্যও বা কী। ইউনিয়ন পরিষদের যে একটি ম্যানুয়েল আছে এ সম্পর্কেও তাদের ধারনা নাই। ফলে তারা বুঝতেই পারেন না তাদের কর্তব্য কতটুকু।
পূরুষ সদস্য ও চেয়ারম্যান যা বলেন তাদেরকে তাই করতে হয়। ইউনিয়ন পরিষদে হতদরিদ্রদের ৪০দিনের কর্মসূচি, কাবিখা, ১%-এর কাজ, বয়স্ক ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফসহ যে সকল সরকারি অনুদান আসে এর সিংহ ভাগই পুরুষ সদস্য ও চেয়ারম্যানরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়ে যান। কিন্তু নারী সদস্যরা থাকেন বঞ্চিত।
রাজনগর উপজেলায় নির্বাচিত নারী সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেলো তাদের অভিযোগ ও অনন্ত দু:খের কথা। সকল নারী সদস্যদের একই অভিযোগ তারা তাদের ন্যায্য অধিকার পাচ্ছেন না। অন্যদিকে তারা জানেনও না তাদের কি অধিকার আছে। ফলে পুরুষ সদস্য ও চেয়ারম্যান যা দেন তাই নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। এতে নির্বাচিত নারী সদস্যরা একদিকে যেমন থাকছেন অবহেলিত অন্যদিকে ব্যাহত হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন।
রাজনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ১ নং ফতেহপুর ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের নির্বাচিত মহিলা ইউপি সদস্য নিয়তি বালা দাস বলেন, নির্বাচন করে জয়ী হয়ে ইউনিয়ন পরিষদে এসেছি। ভোটের যুদ্ধে জয়ী হলেও এখানে এসে নামতে হয়েছে নতুন যুদ্ধে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আজ আড়াই বছর চলে গেল কিন্তু আমরা তেমন কোন কাজই পেলাম না। ইউনিয়ন পরিষদের যে একটি ম্যানুয়েল আছে তা জানি না।
এ ব্যাপারে আমাদেরকে কেউ কিছু জানায়নি। তিনি আরো বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত হয়ে এসেছি আর শুধুই স্বাক্ষর দিচ্ছি। আমাদের কোন কাজ দেওয়া হয় না। এলজিএসপি ছাড়া কোন কাজ পাইনি। এখন ৪০ টনের কাবিখার কাজ এসেছে। আমি অনেক আগে থেকেই বলে আসছি আমার একটি সড়ক মেরামত করা প্রয়োজন। কিন্তু আমার এ সড়কে কোন কাজ না ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ ৪ পুরুষ সদস্য ১০টন করে নিয়ে গেছেন। এমতাবস্থায় আমাদের কিছুই করার থাকে না। ইউনিয়ন পরিষদে আমাদের কি কাজ আছে বা করতে হয় তাও সম্পূর্ণরূপে জানা নাই।
রাজনগর উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের মহিলা ইউপি সদস্য পারভীন আক্তার বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের একটি ম্যানুয়েল আছে জানি। তবে নির্বাচনের অনেকদিন পার করে আজও তা খুলে দেখা হয়নি। কোথায় ম্যানুয়েল পাওয়া যায় তাও জানি না। আমরা যারা মহিলা সদস্য হিসেবে নির্বাাচিত হয়েছি। তাদের কী অধিকার তা আমাদের জানা নেই। বিভিন্ন কমিটিতে আমাদের হয়তো রাখা হয়। এ জন্য সদস্যরা শুধু আমাদের স্বাক্ষর নেন। এটাই শেষ। নির্বাচিত হয়ে আসার পর আজও কাবিখা, ১%-এর কাজ, ভিজিডি, ভিজিএফ, বিধাব ভাতাসহ কোন কিছুই পাইনি। আমাদের যদি কোন ক্ষমতা না থাকে তাহলে কি জন্য আমাদের নির্বাচিত করে আনা হল। এ ব্যাপারে উপজেলা পরিষদ বা সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। তিনি এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের সহযোগিতা কামনা করেন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণাধীন ‘উপজেলা নারী উন্নয়ন ফোরামে’র সভাপতি ও উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ১৯৭৭ সাল থেকে ইউনিয়ন পরিষদে যোগদান দিয়ে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। কিন্তু শুরুতে পারিবারিক ভাবে অনেক বাধা বিপত্তি থাকলেও এখন নারীদের জন্য অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত নারী সদস্যরা এখনো চেয়ারম্যান ও পুরুষ সদস্যদের দয়ায় চলতে হয়। নারীদের ক্ষমতায়ানে উচ্চ পর্যায় থেকে গবেষণা করতে হবে। অন্যদিকে নির্বাচিত নারীদেরও দাবি আদায়ে সোচ্চার হতে হবে। নারী সদস্যদের অধিকার নিয়ে ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানদেরকে সহনীয় মনোভাব রাখতে চাপ বা প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।