গল্প :: মাছের প্রতিবেশী
প্রকাশিত হয়েছে : ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ
প্রবীর পাল ::
সকালবেলা বুড়ি কাননবালা গোবর পানির ছিটা দিয়ে তাদের বড়ো উঠানটা প্রায় শেষ করে এনে গোয়ালঘরের দিকে গেছে আরেকটু গোবর আনতে, হঠাৎ দেখে, দত্তপাড়ার ননী দত্ত সন্তর্পণে তাদের ঘরে ঢুকছে, দেখেই বুড়ির মেজাজটা গরম হয়ে গেল।
ননী দত্ত দিনমজুর ধরনের মানুষ, রাতদিন পড়ে থাকে চিত্তানন্দ দত্তদের বাড়ি, এখন ননীকে কিছু বললে বা গালি দিলে তা গিয়ে লাগবে ঐ চিত্তানন্দ দত্তের গায়ে। চিত্তানন্দ গ্রামের সম্মানীয় লোক। বুড়ি আপনমনে গজরায়, সকালবেলা এই ননী লক্ষ্মীছাড়ার মুখ দেখার ফলে সারাদিনটা না জানি কেমন যায়! হরি! রক্ষা করো। এই ক্রোধের ঝাঁঝ লাগে উঠানের গায়ে, তার হাতের ঝাঁটার সরু শলাগুলিতে বুড়ির মেজাজের সোরগোল ওঠে, ঝাঁট দেয়ার নামে বুড়ি ঝটাস ঝটাস শব্দে ঝাঁটা দিয়ে উঠান পেটাতে থাকে।
ননী বুড়িকে দেখেই নাই, তার লক্ষ্য বুড়ির চোখ এড়িয়ে ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত কালীপদকে দুইটা ধাক্কা দেয়া, এক ধাক্কাতেই তার ঘুুম ভাঙবে, দ্বিতীয় ধাক্কায় ননীকে দেখতে পাবে, দেখলেই মনে পড়ে যাবে আজ চিত্তানন্দদের পুকুরে তার জাল বাইতে যাবার কথা, মুখে কিছুই বলতে হবে না।
ননী কাননবালাকে একটু ভয়ই পায়, যদিও তা সে কখনোই স্বীকার করে না মুখে, এই সকালবেলা মুখোমুখি পড়ে গেলে আবার কোনো বিপত্তি না ঘটে, বুড়ির চোখের চাওয়াতেই এমন ‘দূর হ দূর হ’ বার্তা, একটু হেসে ‘কেমন আছো মাসি’ জিজ্ঞাসা করার কথা মনে এলেও ননীর মুখে আর আসে না। তাই পা আলগা করে ফুরুৎ করে ঘরে ঢোকা, আবার সুযোগ খুঁজে নিয়ে ফুরুৎ করে বের হয়ে যাওয়া।
কিছুক্ষণ পর ননী ও কালীপদ যখন সন্তর্পণে বের হয়ে আসে, তারা পড়ে যায় কালীপদের বউ সন্ধ্যারানী ও মা কাননবালার একেবারে মুখোমুখি। উভয়েই দাঁড়িয়েছিল তাদের পাকড়াও করার জন্যই, এখন নাগালে পেয়ে ননীকে কেউ কিছু বলল না, ননী দ্রুত পা চালিয়ে ভাগে, কালীপদ ঢিমেতালে উঠান পার হতে গেলে কাননবালার তীব্র চিৎকারে তার কানে তালা লেগে যায়।
আজ কালীপদকে বাগে পেয়েছে বুড়ি, এমন সচরাচর পাওয়া যায় না, সেও কোন ফাঁকে সরে পড়ে চড়–ই পাখির মতো, বুড়ির এমন সর্বব্যাপী চোখ, প্রখর জ্যোতি, কিন্তু তার চেয়ে চালাক তার ছেলে কালীপদ। দিনের শুরুতে তাকে পাওয়া মুশকিলও বটে। এমনই মা ও ছেলের প্রতিদিন চোর পুলিশ খেলা, যাতে প্রতিদিনই হারে কাননবালা, আজ হারল কালীপদ।
‘বেইন্নাস্সঅরে বেইন্না, ছঁইয়র গিল্ ন’দি হডে যঅজ্জে? আজিয়া হ’দিন ধরি দিবি দিবি হ’চ, ছঁইয়র লতাইন তোর কী লাগে, তোর মুয়র কথা ধরি বই থাইবঅ না? গিলবাই নুউডিলে ইনঅরে বাঁচাইত্তারিবি না? সম’ গেলেগই…, আঁই হ’তে হ’তে মুক ভোতা গরি ফেলাইর, তোর বউ উ¹া অরিপ মাইয়াফুয়া’…
ননী দ্রুত পা চালিয়ে ওদের বাড়ির সীমানা পার হয়ে গেছে, আরো কয়েকটা বাড়ি পেছনে ফেলে বুড়ির দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে কালীপদের জন্য অপেক্ষা করছিল, অপেক্ষাও সে করতে পারছিল না সুখে, বুড়ির প্রতিটি আওয়াজ তাকে এক পা এক পা করে আরো পেছনের দিকে ঠেলছিল।
এদিকে কালীপদের মুখের আওয়াজ বন্ধ, সে অভিজ্ঞতা থেকে জানে, এখন কিছু বলতে যাবার মানে মা ও বউ উভয়েরই আক্রমনের মুখে পড়া; তার চেয়ে যে যা বলছে বলুক, এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়ে কোনোক্রমে উঠানটা পার হতে পারলেই সারাদিনের জন্য আর চিন্তা নাই।
এই পার হওয়াটাই কঠিন, বুড়ি আজ ননীর মুখ দেখে ও কয়েকদিনের ক্ষোভ মিলে রেগেমেগে সীম গাছের খুঁটি না পোতার প্রসঙ্গ নিয়ে এমন চেপে ধরেছে যে, মিটি মিটি হেসে পরের পুুুকুরের মাছ ধরে পরেরই হাতে তুলে দিয়ে আসার বায়না নিয়ে দিন শুরু করা কালীপদ খুবই বেকায়দা বোধ করে। ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে ননী, সে সম্মানীয় লোক চিত্তানন্দ দত্তের ‘নিজের লোক’, তার অপেক্ষায় না কি আছে অনেকে, সে এসব ক্ষুদ্র সাংসারিক কাজ নিয়ে দশজনের ডাক উপেক্ষা করে নাই কখনো, তার ধাতেও নাই তা, আজও দক্ষ খেলোয়াড়ের মতো আগুপিছু করে কোনো এক ফাঁকে, বুড়ির প্রায় কোনো কথারই জবাব না দিয়ে, ফুরুৎ করে উঠানটা পার হয়ে যায়। পেছনে উড়তে থাকে বুড়ির চিৎকার।
কাননবালা সহজ বুড়ি নয়। কোমরে হাত দিয়ে নেচে নেচে যখন সে কারো সাথে ঝগড়া করে, তখন তার প্রতিটি বাক্যের যুক্তি ও পুরো বক্তব্যে যুক্তির ঐক্য ধরে রাখার অদ্ভুত ক্ষমতার প্রদর্শণ, কাঁসার থালায় হাতুড়ির বাড়ির মতো ঝনঝনে হৃৎকম্প তৈরি করা আওয়াজ, সব মিলিয়ে সে এক জমজমাট অবস্থা তৈরি করতে পারে। যুক্তি, কথার ঝাঁঝ ও আওয়াজে প্রতিপক্ষের ফালা ফালা না হয়ে উপায় থাকে না। কিন্তু কালীপদ? গরম তেলে শুকনা মরিচ পড়লে যে নাকফাটা ঝাঁঝ ওঠে, সে ঝাঁঝে যতই তীব্রতা থাক, তা যেমন রাঁধুনীর নাক সওয়া, গা সওয়া, চোখ সওয়া, প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতায় আলাদা কোনো তাৎপর্য থাকে না তার, প্রকৃতির হাজার শব্দের মতোই আরো কিছু শব্দ; কালীপদের আশপাশ দিয়ে উড়তে থাকে, কালীপদ সতর্ক থাকে যেন শব্দগুলি তাকে না ছোঁয়, সে ‘এই গেলাম আর এলাম’ বলে বুড়ি ও তার বউয়ের কবল থেকে বাইন মাছের মতো গলে যায়।
বুড়ি সবশেষে বলে, কালীপদকে একদিন মাছে খাবে।
২
কালীপদের, তার বংশের তেমন কোনো জমজমাট ইতিহাস নাই। নির্বিরোধ, নির্ভেজাল এবং অস্বাভাবিক রকমের ভালো মানুষ সে, তবে তার ভালোমানুষির কোনো দামই নাই সমাজে, সে এমন একজন মানুষ যার নিজের ভালোমন্দ অন্য কারো ভালোমন্দ ঘটায় না, কাজেই সে কেমন মানুষ তার খোঁজ নিতান্তই অর্থহীন। তিন সন্তান, মা ও স্ত্রীকে নিয়ে সে বাড়িতেই থাকে। তাকে কেউ ‘পেশা কী’ জিজ্ঞাসা করলেও সে একই জবাব পায় যে, সে ‘বাড়িতে থাকে’।
এখানে পেশাগত পরিচয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে কথাটি একটু তলিয়ে দেখলে। ঐ তলিয়ে দেখতে গিয়ে শহুরে আত্মীয়রা সাধারণত তালগোল পাকিয়ে ফেলে। বলে, বাড়িতে থাকি, আবার কী? কী কর মিয়া, খুলে বল না। তখন পাশের কাউকে হয়তো এগিয়ে আসতে হয়, আসলে বাড়ি থাকা মানে হল গিরস্থি করা। এই জমিজিরাত আছে, তা দেখা, পুকুর আছে তা দেখা, ক্ষেত খামার আছে… এই আর-কি।
কালীপদ কখন নীরবে পঁয়তাল্লিশ পার হয়ে যায়, কেউ জানে না, সে সংসারের হাল ধরে আছে দশজনে জানে, সে গিরস্থি করে তাও জানে দশজনে, কিন্তু এ জানার মধ্যে ভালোই ফাঁক আছে। স্বভাবত মৃদুভাষী কালীপদের জীবনযাপনের সীমানা সপ্তাহে দু’দিন বাজার, বিল-ক্ষেত-মাঠ, সন্ধ্যায় কীর্তনের আসর বা চায়ের দোকান জুড়ে থাকলেও তার অন্তর্মুখী প্রবণতার জন্য সে কখন এল বা গেল তার পাশের লোকটিও টের পায় না, সে সব জায়গাতেই নিজের বিবেচনায় আসে যায়, এমন থাকা না থাকার মাঝখানে সে সবজায়গায় থাকে যে, তাতে কারো ক্ষতি বা লাভ বৃদ্ধির কোনো কারণই ঘটে না। সে এমন একজন মানুষ যাকে চোখে পড়লেও দেখে না কেউ।
সমাজে তার গুরুত্ব পাল্টাতে শুরু করেছে গত মাস ছ’য়েক ধরে। দিনটা জানে একমাত্র কালীপদই, আর কেউ নয়, আলাদা করে দিনটার গুরুত্ব তার কাছে আছে, অন্যরা হয়তো সুস্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করতে পারে না, করে না প্রয়োজনও নাই বলে, গ্রামের লোকের কাছে কোনো অতীতের বিশেষ দিনের চেয়ে সামনের বিশেষ বিশেষ দিনগুলিতেই সে মনোযোগের কেন্দ্রে আসে।
তাদের গ্রামের নাম কাঞ্চননগর। হিন্দু পাড়ার আকারটা বেশ বড়ো। সেনপাড়ার নিধুবাবুর পিতা একদিন দেহ রাখলে এবং সেই ঘটনার পর এক মাস পূর্ণ হলে শ্রাদ্ধের দিন তাদের পুকুরেই মাছ ধরার উদ্যোগ নেয়া হয় দুপুরবেলার ৩৫০ জন নিমন্ত্রিতের তুষ্টির জন্য। তাদের বিশাল পুকুরে মাছের যে প্রাচুর্য, তাতে নিধুবাবু ছয়জনের হাতে জাল তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তই ছিল। নিধুবাবু তার বউ এবং ছোটোভাইয়ের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে জেলে ডাকার প্রস্তাব উড়িয়ে দেয় এই বলে যে জেলে ডাকলে তাদের যে চাহিদা, পুকুর থেকে তোলা মাছের অর্ধেক অথবা টাকা, পোষাবে না, তার সহজ হিসাব ৩৫০ জন লোকের জন্য বড়ো জোর ৩০/৩৫ কেজি মাছ লাগবে, তাদের পাড়ার পাঁচজন এবং ধরপাড়ার কালীপদ ছয়জন মিলে দশটা খোপ মারলে কাজ ফতে। সেখানে জেলেদের সাথে ঐ সব লম্বাচওড়া হিসাবে যাবার দরকার কী? সেনপাড়ার পাঁচজনের সাথে ধরপাড়ার কালীপদের মিশে যাওয়ার যুক্তি হচ্ছে তার সততা ও খ্যাতি। জাল দিয়ে মাছ ধরতে তার অসামান্য দক্ষতার জন্য সে হিন্দুপাড়ায় বিখ্যাত। আবার আরেক বিবেচনায়, এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে কালীপদও নিমন্ত্রিত, আবার সেনপাড়ার সবাইও নিমন্ত্রিত। ফলে সর্বজনীন কাজের আদলে সবার অংশগ্রহণে পাকা গৃহস্থ নিধুবাবুর কাজটাও উদ্ধার হয়ে গেল।
ঐ দিনই নিজের ভিতর একটা অচেনা অনুভূতি, একটা শিরশিরে পরিবর্তন টের পায় কালীপদ। পুকুর পরিষ্কার। কলাগাছের ভেলা বেঁধে বীর ব্যাধের মতো দুই একজন সহকারী নিয়ে পুকুর গ্রাস করে ফেলেছে ওরা ছয় জন। পুকুরপাড়ে কৌতূহলী জনতা ও উদ্বিগ্ন নিধুবাবু, রাগান্বিত বউ ও তার ছোটোভাই। প্রচ- যতœ ও গভীর মনোযোগ দিয়ে জাল ফেলে যাচ্ছে সবাই, প্রতিটা খোপের পরপরই সবাই তাজ্জব হয়ে যায়, শূন্য জাল উঠে এসে জনতাকে তাক লাগিয়ে, বোকা বানিয়ে নিধুবাবুর চওড়া কপালে পানি ও ঘাম মিশে একাকার হয়ে, তার জীবনের অভিজ্ঞতাটাই যেন বড়শির মতো প্রশ্নবোধক হয়ে শূন্যে ঝুলিয়ে দেয়। পুকুরভর্তি মাছ গেল কোথায়?
রোদ চড়ে যাচ্ছে, নিধুবাবুর কপালের রেখা দীর্ঘ ও গভীর হচ্ছে। ‘মা তারা তোর চরণে কী অপরাধ করেছি, এ কোন পরীক্ষার ফেললি তুই’! এ ধরনের বিভিন্ন কথা তার মনে আসতে থাকে ঘন ঘন।
পুকুরপাড়ের আলোচনা যখন বাজারের মাছ কেনা বা অন্য পুকুরের দিকে যাচ্ছিল এবং ছয় জনের উপর বা ঐ পুকুরের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছিল জনতা, তখনই ভেলার উপর দাঁড়িয়ে মাঝ পুকুরে ভাসতে থাকা কালীপদের ছোটো চোখ জোড়া আরো ছোটো হয়ে যায়। তার চওড়া কালো শরীর জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম ও জলের ছিটা আলাদা করে চেনা যায় না, পুকুরপাড়ের চারিদিকের কোলাহল, জলের আলোড়ন ও ঢেউ ও হরেক শব্দ ছাপিয়ে সে হঠাৎ ডানে ঘাড় ঘোরায়। কালীপদের জাল মেলে ধরা ত্রিভঙ্গ মূর্তি মুহূর্তে নিশ্চল হয়ে এক অচেনা বার্তায় স্তব্ধ হয়ে যায়, ছোট্ট তিন-চারটি বুদ্বুদ, সামান্য জায়গা জুড়ে পানির মৃদু অথচ ভারী থর থর কম্পন যেন পুকুরের মাঝে আরেকটা ছোট্ট পুকুর সৃষ্টি করেছে বিপরীত বৈশিষ্ট্য ও সম্পদ নিয়ে।
তার পায়ের আঙুলগুলো ভেলা আঁকড়ে ধরে, দেহের উপরের অংশ হঠাৎ একটি ঝাঁকুনি খায় আর জালটি বিশাল বৃত্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কালীপদের চোখ দিয়ে পুকুরের বুকে আঁকা আর একটি বৃত্তে।
তারপর সে ভেলাটা নিয়ে পাড়ে আসে, পুকুরের তলদেশ কামড়ে ধরার সুযোগ দেয় জালটাকে, তাতে এমনকী সামান্যতম টানও যেন না লাগে মাথায় রেখে দড়ি ছাড়তে ছাড়তে পাড়ের কাছাকাছি এসে যায়, নামে হাঁটুপানিতে, তারপর জালের দড়িটা হাতসহ পানির নীচে ডুবিয়ে, যেন কোনো গোপন ব্যাপার, অতি ধীরে টানতে থাকে।
এসব কর্মকাণ্ডে দশজন অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, পাড় জুড়ে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে, লোকজন তাকায় পরস্পরের দিকে, এমনকী সহকর্মী অন্যরাও যারা জাল হাতে ছিল, উপস্থিত সবাই কালীপদের ফুলে ফুলে ওঠা বাহুর পেশীর দিকে তাকায়, পেশীর ঢেউ দেখে আর ফিস ফিস করে।
জালটা প্রায় গুটিয়ে নিয়ে এলে কালীপদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তার সামনে দুই গজের মধ্যে যেন পুকুরের সব মাছ প্রচ- কোলাহলে মাতিয়ে তুলেছে, জাল ভর্তি হয়ে গেছে মাছে আর জালসুদ্ধ কালীপদকে জনতা তুলে এনেছে পাড়ে। পাড়ার লোক ভেঙে পড়ে ভীষণ কলরবে, আলাদা করে নিধুবাবুর উচ্ছ্বাস ও বিজয় গর্ব তার চাপে পিষ্ট হয়ে যায়, সে ভাঙা গলায় কেবলি বলতে থাকে, সংসার বুদ্ধিতে তার চেয়ে সেরা আর কে আছে? এক কেজি ওজনের নীচের মাছগুলি ছেড়ে দেয়া হয়, বাকিগুলির দিকে সন্তুষ্টচিত্তে তাকিয়ে নিধুবাবু কালীপদকে বলে, আরেকবার জালটা ফেলবে কিনা, ততক্ষণে বাকিরা যারা জাল হাতে ছিল তারা দর্শক, আর এদিকে কালীপদও তৈরি। সে তার পরের খোপটি মারার জন্য আবার ভেলায় ওঠে, বাকি পাঁচজন তাকে সমীহ করা শুরু করে এবং ঐ দিনই সে হঠাৎ আলাদা হয়ে যায়, তাকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে, তার গ্রীবা তুলে হাঁসের মতো কিছু খুঁজে বেড়ানোর ভঙ্গিটা রাজকীয় মনে হচ্ছে, তার শরীরের বাঁকগুলি কারো সুনিপুণ শিল্পচর্চার মর্যাদা পাচ্ছে। এভাবে সেদিনই আলাদাভাবে কালীপদ ‘কালীপদ’ হিসাবে খ্যাতি পেয়ে যায়।
খ্যাতিটা সে এমনভাবে পায় যে আলাদা করে ঐ দিনটির কথা কেউ আর মনে রাখে নাই, এক কালীপদ ছাড়া।
এরপর থেকে প্রতিটা উৎসবে, অনুষ্ঠানে ডাক আসতে থাকে, সে নীরবে যায়, বিনা প্রশ্নেই, যেন আগে থেকেই জানা ছিল, এই ডাক আসবে। গ্রামে, পাড়ায় শত্রুর সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, জুটে যায় অসংখ্য ভক্ত, সেও জাল উঁচিয়ে ভেলায় চড়ে, অভিজ্ঞ গ্রীবা তুলে তার ছোটো ছোটো চোখ জোড়া দিয়ে পানির ঘনত্বকে চিরে ফেলে।
৩
কাননবালার আপত্তি হ’ল তার ছেলেকে সরলসোজা পেয়ে লোকে ঠকাচ্ছে। এমন নয় যে, লোকে খাতির করে তাকে ডেকে নিচ্ছে বলে, রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে দাঁড়িয়ে দু’টা কথা বলছে বলে তার আনন্দ নাই। আছে। ভালোভাবেই আছে। ‘তাদের কে কবে খাতির করেছে মানুষ হিসাবে’! আজ যে কারণেই হোক বেকুবটাকে যে খাতির করা শুরু করল লোকে, কোনো এক অজানা কারণে, সবই তো ভগবানের লীলা।
নিজের কাজ ফেলে, নিজের সংসারের হাজার জরুরি প্রয়োজন তুচ্ছ করে প্রায় বিনা নোটিশে যখন তখন যেখানে সেখানে ছুটে যাওয়া তার যে স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেল, সংসারজ্ঞান কিছুটা থাকলে এমন কুবুদ্ধি মানুষের অন্তত হয় না। সে হাজারটা মাছ মারলেও ঐ মাছে যেন তারই অধিকার সবচেয়ে কম; কেউ যদি বলে, কালীপদ একটা মাছ নিয়ে যা, ছেলেদের সাথে খাবি, এমন প্রত্যাশা অবশ্য সে করে না; যদি বলত, কাননবালার সারাদিনের গজর গজরের একটা জুতসই জবাব হত। বেকুব তাকে এ কারণেই বলছে বুড়ি, যে, তিনটা ছোটো ছোটো বাচ্চা, তাদের কথাও মুখে আনে না লোকে, সারাদিন খাটিয়ে নিয়ে আলগা স্বরে কালীপদকেই শুধু ভাত খাওয়ার আমন্ত্রণ?
দেশের মানুষের কি বিবেক বলতে কিছু রইল না?
৪
নিজের মধ্যে ঐ অদ্ভুত ক্ষমতার অস্তিত্ব সে যেদিন থেকে টের পায়, সেদিন থেকে সে যেন অন্যমানুষ। লোকে অবশ্য টের পেয়েছে অনেক পরে, অনেকে স্বীকার করতে চায় নাই, অনেকে অনেক কাল্পনিক উদাহরণ সৃষ্টি করে কালীপদকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, কিছুতেই আপত্তি ছিল না তার, ঐ অনাপত্তি এবং প্রয়োজনে তাকেই স্মরণ করার গরজ অল্প দিনেই গ্রামে আলাদা মর্যাদায় অভিষিক্ত হয় সে। সেদিন সে ননী দত্তের সাথে চিত্তানন্দের বাড়ি যখন পৌঁছাল, শুনল শহর থেকে এক মোটা, গোঁফঅলা ও চশমা পরা লোক, তার জন্য না কি বসে আছে। বৈশিষ্ট্যগুলি ফিসফিস করে ননীই বলল, লোকটি যে কে তার হদিস সে সঠিকভাবে দিতে পারে নাই, শুধু ইঙ্গিত দেয়, চিত্তানন্দ বাবুর শ্বশুরবাড়ির দিককার কোনো আত্মীয়।
লোকটি সরকারি গোয়েন্দার মতো তার দিকে কিছুক্ষণ কুতকুতে চোখে তাকাল, তাকিয়ে কী সব মাপজোক করল, মুখে কিছুই বলল না।
কালীপদ জানে এনার সৌজন্যেই ডাক পড়েছে আজ। শ্বশুরবাড়ির দিককার সম্মানিত আত্মীয়, নিজের পুকুরের সব চাইতে বড়ো মাছটা দিয়ে খুশি করতে না পারলে গৃহস্থ হিসাবে চিত্তানন্দ বাবুর সম্মান যায় যায়।
সকালেই পুকুরে চার-পাঁচজন লোক নেমে গেছে। কেউ কলাগাছের ভেলা তৈরি, কেউ শ্যাওলা বা জলজ উদ্ভিদ সরাতে, কেউ-বা পুকুরের ভেতরের পানির নীচে লুকানো গাছের ডাল সরাতে ব্যস্ত, কালীপদ পৌঁছার পরপরই পানির ময়দান প্রস্তুত হয়ে উঠলে কালীপদ অবাক হয়ে দেখে যে চশমা-পরা গোঁফঅলা লোকটাও শার্ট খুলে ফেলে লুঙ্গির গোছ মারল, সেও তুলে নিল একটি জাল আর শূন্যে জালটি ছড়িয়ে এমনভাবে এক ঝাড়া দিল যে বামহাতের পাঁচটি আঙুলের পাঁচটি আংটিই সূর্যের আলোয় ঝিলিক মারল।
চিত্তানন্দ হাসি হাসি মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে সতর্কভাবে তার আত্মীয়ের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য তার কাছাকাছিই থাকছে সব সময়, এমনকী তার সাথে ভেলায় উঠবে কিনা একবার আগাম জানতেও চাইল।
কালীপদ লক্ষ করে, লোকটির সাধারণ শহুরে লোকের মতো গায়ের রঙে কোমলতা নাই, কেমন রোদপোড়া, কাঠখোট্টা খসখসে ত্বক, রুক্ষ মুখ, চশমা না থাকলে ঐ লোককে শহুরে বলেও চিহ্নিত করাও মুশকিল হত। তার উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটিও সে খেয়াল না করে পারে না।
মা ও স্ত্রীর আজ সকালের তর্জন গর্জন হঠাৎ কালীপদের কানে ভেসে আসে, মনে হয়, ধুউর, দু’টো খোপ মেরে বিদায় হই। আজ জাল বাওয়ার মেজাজটিই পাচ্ছি না। তার উপর আবার এই লোকটি, যার তাকানো ও গাম্ভীর্য্য তাকে চরম অস্বস্তিতে ডুবিয়ে রেখেছে প্রথম থেকেই। তাই সকালটা উপভোগও করতে পারছিল না তার মতো; ননীকে তাড়া দেয় সে, তাড়াতাড়ি ঘরে যাব, কাজ আছে। অর্থাৎ জাল দাও, নেমে পড়ি। ননীও তাচ্ছিল্যের সাথে বলে, ‘যাইবা এ’রি’। কালীপদ তখন আর কিছু বলে না, সে পুকুরপাড়ে বসেছে উবু হয়ে, চিত্তানন্দ একটু পরপর এসে তার দিকে তাকিয়ে হেসে যাচ্ছে, মানে, ‘ভালো’ ‘ভালো’, আর লোকটি অবহেলায় পায়ের কাছে জালটি শুইয়ে রেখে ধপাস করে হাতলঅলা চেয়ারে বসে পড়ে। তার জন্য পান এসেছে। থালা থেকে জর্দা, বাছাই করা সুপারি, চুন নিয়ে, সময়টা উপভোগ করতে করতে, সে নিজের হাতেই মনের মতো একটি পান বানায়, তার হয়ে গেলে থালাটি নেয় চিত্তানন্দ, ততক্ষণে কালীপদের চোখ ছোটো হয়ে আসে, তার চোখ পুকুরের পানিতে হেঁটে বেড়ায়।
কলাগাছের ভেলার উপর দাঁড়িয়ে হাঁসের মতো গলা তুলে লোকটিও পুকুরের প্রতি ইঞ্চি ভাগ করে ফেলে। পুকুরপাড়ে দাঁড়ানো কৌতূহলী লোকজন, কালীপদ স্বয়ং, পুকুরের মালিক চিত্তানন্দ কোনো কিছুই তার নজরে আসে না, পুকুরের মাঝখানে বা কিনারার কাছাকাছি যেখানেই তার ভেলা ভেসে বেড়াক, সে সবার দিকেই তাকাচ্ছে অচেনা চোখ দিয়ে, যেন কোনো এক ঘোরের মধ্যে ডুবে গেছে, পাড়ের জগতটাই তার চেনা নয়, তার দেশ ও বাস এই ভেলা, এই ভেসে বেড়ানোটাই তার নিজস্ব জগৎ। চিত্তানন্দ সন্তুষ্ট হয়ে কালীপদের কাছে এসে উবু হয়ে বসে, চোখ নাচায়। অর্থাৎ, কেমন দেখছ?
একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল কালীপদ, সে তার বাড়ির উঠানের ডান পাশের কোণে সীমের খুঁটি পোতার জন্য মাত্র হাত তুলেছিল, বউয়ের গজ গজ আর মায়ের চিৎকারে বড়ই পেরেশানিতে আছে সে, তার চমক ভাঙে। কালীপদ নিজেও খেয়াল করেছে লোকটার হিসাবি চাল, দাবাবোর্ডের ছকের মতো প্রতি ইঞ্চিই আয়ত্বে নিয়েছে সে, দক্ষ দাবাড়–র চোখ বন্ধই থাক আর খোলাই থাক, তার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ যেমন দাবার প্রতিটি অংশেই সাড়া দেয়, শহুরে লোকটির হিসাবই তেমন আলাদা ঠাওরে নিজেকে হালকা বোধ করে কালীপদ। এ যাত্রা যদি, এ লোক, চিত্তানন্দের চাওয়া পূরণ করে ফেলে অর্থাৎ বড়ো বড়ো দু’চারটা মাছ ধরে ফেলে তাহলে আজ তার মাফ। আজ বাঁচা গেল।
তার মনও আজ ছুটে ছুটে যাচ্ছে। আশপাশে ঘুরছে ননী, দত্তবাড়ির ছেলে মেয়েরা, স্বয়ং চিত্তানন্দ, পাড়ার লোক, সবই চোখে পড়ছে তার। চোখ বার বার সরে যাচ্ছে পানি থেকে, কোত্থেকে এই উটকো লোক যে জুটল আজ, এখন কতক্ষণ যে বসে থাকতে হয়! দত্তবাবুর মতি বোঝাও মুশকিল, এখন চলে যেতে চাইলেও হৈ হৈ করে উঠবে বাবু, আবার এখনি পুকুরে নামতেও না করেছে। প্রথমে, আগে নামবে ঐ শহুরে লোক, সে মাছ ধরবে অথবা তার ধরা মাছ ছেড়ে দেয়া হবে, ততক্ষণে পুকুরপাড়ে বসে বসে ঝিমাই, কতক্ষণে বাবুর মর্জি।
কালীপদ ঝিমাচ্ছিলও, থেকে থেকে চমক ভাঙে সম্মিলিত চিৎকারে। ঐ লোক এক একবার জাল নিয়ে পাড়ে আসে, ভেলা থেকেই লাফ দিয়ে নামে পাড়ে, হাতের জালের দড়ি মাছের ভারে টান টান হয়ে থাকে, জালসহ মাছের ঝাঁক পাড়ে এলেই মাছের দাপানো, পানির কল্লোল উপস্থিত দর্শকদের সীমাহীন উল্লাসে মাতিয়ে দেয়। দর্শকরা আনন্দে পাগল, চিৎকার করতে করতে গলা বসিয়ে ফেলে, ননী, চিত্ত তাচ্ছিল্যে তাকিয়ে যায় কালীপদের দিকে, তাকে সচেতন করে রাখে, ‘তোমার চেয়েও ওস্তাদ লোক আছে দেশে, এই বাড়িতেই আছে।’
কালীপদ হঠাৎ বলে, অ দা, আঁই যাইর।
হা হা করে ওঠে চিত্তানন্দ, পাগল! পাগল না কি? এবার তোমার পালা, জাল নিয়ে নেমে পড়।
মন টানছে না দাদা।
আহ্। চরম বিরক্ত হয় চিত্ত। মনে করেছ পুুকুরে মাছ নাই আর? সব তোলা শেষ? তোমার জন্য খালি দু’টি সরপুটি আছে? তাই পালাচ্ছ?
না দাদা, তা না, মাছ আছে। আপনার যা লাগবে, এই শহরের দাদাটি তুলে দেবে, ওস্তাদ লোক।
পরাজয় স্বীকার করছ?
জয় পরাজয় এখানে নাই দাদা। আমি সে হিসাব করি না।
তাহলে পালাচ্ছ কেন? থাকলে কিছু কেরামতি দেখাও।
সবাই চেপে ধরে কালীপদকে; কালীপদ, গ্রামের মান রাখ। পালিয়ে যেও না, আগে নেমে লোকটি যে অন্যায় সুবিধা পেয়েছে তার জবাব দাও। তোমার দিকে তাকিয়ে আছে সবাই, মান রাখ; কালীপদ, মান রাখ।
কালীপদ ঝাঁকার দিকে তাকায়। যা তোলা হয়েছে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, যা ছাড়া হয়েছে তাও বাজারে তুললে দেখার জন্য লোক জমে যাবে। চিত্তানন্দবাবুর পুকুরটা যেন মাছের খনি। উর্বরতা আর ভাগ্যে মাখামাখি।
লোকটি সরু চোখে তাকিয়ে আছে কালীপদের দিকে, সেও তখন পাড়ে। ভেলাটি চালকবিহীন পাড়ের সাথে বাড়ি খাচ্ছে। পেছনে জনতার উল্লাস, রুপালি রুই-কাতলার চকচকে বিকিরণে লোকটার দাঁত ঝিলিক দেয়, তার আঙুলের আংটিগুলি কথা বলে ওঠে।
কালীপদ বলে, আইচ্ছা লামিলাম…
সে জালটা কপালে ঠেকাতেই উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা, পাড়া ভেঙে লোক জড়ো হয়ে গেছে, দত্তবাড়ির পুকুরের চারটা পাড়ই যেন গাছ ও ঘাসের মাথা ছাড়িয়ে গেছে মানুষের মাথায়।
কালীপদ ভেলার উপর দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ ছোটো করে আনলে পাড়ের লোক স্তব্ধ হয়ে যায়, নিঃশ্বাসের শব্দ ও বাতাসের শব্দ মিশে কানের কাছের চুপি চুপি শোঁ শোঁ আওয়াজ ছাড়া আর কিছু নাই এলাকায়, তার মধ্যে একটি অন্যরকম শব্দ শুধু, শহুরে লোকটির সুপারি চিবানোর খট্ খট্ শব্দ, মাছ ধরা নিয়ে লোকের এরূপ উদ্দীপনা বা উদ্বেগ তাকে বিরক্ত করে তুলেছে। সে এক সময় ফিচ্ করে পানের পিক ফেলে ঘরে ঢুকে যায়।
৫
লেবু গাছের পরিচর্যা বা সীম গাছের খুঁটি পোতা, পেঁপে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করা সব কাজেই ইদানীং কালীপদের অদক্ষতা চোখে পড়ছে। মাঝে মাঝে উদাস হয়ে বসে থাকে কারো পুকুরপাড়ে। সন্ধ্যারানী বা মা কাননবালা কোনো প্রশ্ন করলেও সে সাড়া দেয় অনেকক্ষণ পরে, হয়তো একদিন পরে, যখন ঐ জবাবের গুরুত্বই শেষ হয়ে গেছে।
৬
একদিন ফিসফিস করে নিধুবাবু জিজ্ঞাসা করে, আঁরে শিঘাবি না?
কালীপদ হা হয়ে যায়, এমন রাতে বাড়ির পেছনে আমগাছের ঝোপের আড়ালে লোকচক্ষুর অন্তরালে গা ছম ছম করা পরিবেশে দাঁড় করিয়ে নিধুবাবু এ কী প্রশ্ন করল তাকে!
কালীপদ বলে,‘কী শিঘাইবার হতা হতন যে’?
সাথে সাথেই জবাব দেয় না নিধু। সময় নেয়। সে চালাক মানুষ, সময়টা হয়তো দেয় কালীপদকে। সে ভাবুক, যদি দর হাঁকে তাও রাজী নিধু, জীবনে অনেক কাজে অকাজে টাকা ঢেলেছে সে, তার ফল কী? ফল যেই নিধু সেই নিধু। আজ জীবনের শেষদিকে যদি এই বিদ্যা ধরা যায়, তাহলে জীবনে একটা নাম রেখে গেল।
নিধুবাবু বলল, ‘আঁরে শিঘাই দিবি কালীপদ, যিয়ান চাচ্ Ñ পাবি’।
তার কণ্ঠ উপরে ওঠে নাই, বরং আরো নিখুঁত, আরো খাদে পড়া অথচ দৃঢ়। কালীপদের গা কাঁটা দেয়। বলে, অদা, বিশ্বাস গরন, এডে শিঘাইবার কিচু নাই।
নিধু একটু গম্ভীর হয়, এই কথাটা তো সবার জন্য বলা। আমার জন্য নয়, আমাকে আসল কথাটা বল। তোর জালে সেঁধোবার জন্য দুনিয়ার সব মাছ পাগল হয়ে আছে কেন?
কালীপদ অবাক হয়। পাগল হয়ে আছে! কালীপদ ভীষণ অবাক হয়। জ্ঞানী লোক নিধুবাবু, ক্ষমতাশালী, বুঝদার মানুষ নিধুবাবু, এ কী বলছে সামান্য কালীপদকে?
সোজা করেই বলি, তুই যখন জাল নিয়ে ভেলার উপর খাড়া হোস, তখন তোর চোখ আমি দেখেছি। ও চোখ চেনা যায় না, তুই কি একটা খুঁজে বেড়াস, কারো চোখে তখন চোখ পড়ে না তোর। যখন তখন খোপ মারিস না, যখন মারিস তোর জাল মাছের ভারে ছিঁড়ে যায় যায়। এখন আমাকে বলবি কী খুঁজে বেড়াস তুই? কী চিহ্ন ধরে তুই জাল ফেলিস?
ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে হাসে কালীপদ। এ অতি সামান্য কথা, এ কথা সবার সামনে অনেকবার বলেছে সে, লোকজনকে পাখিপড়ার মতো পড়াচ্ছে, কেউ বিশ্বাস করছে, কেউ করছে না; এই না করার দলে যোগ হল নিধুবাবু।
তবু বলল, দাদা, এইটা গোপন কোনো বিদ্যা নয়। চোখের মাপ মনের আন্দাজ। মাছে যেখানে জড়ো হয়, ছোটো ছোটো বুদবুদ ছাড়ে, লক্ষ্য করে না দেখলে বোঝা যায় না, ঐ লক্ষ্য করাটা শিখতে হবে, আর কিছু নয়।
নিধুবাবু সন্তুষ্ট হয় না। বলে, এ কথা তো সবাইকে বলে বেড়াস, আমাকে অন্য কিছু বল।
কালীপদের আর কিছু বলার নাই, সে আর কিছু জানেও না। একই কথা, ঘুরিয়ে বুঝিয়ে, ব্যাখ্যা করে অবিরাম বলে যায় সে। নিধুবাবু মানী লোক, তাকে বোঝানোর মধ্যেও এক ধরনের বেয়াদবি ও সুখ রয়েছে, রাতের অন্ধকারে নির্জনে তার আকুতি ও আত্মসমর্পণ কালীপদকে ব্যস্ত করে তোলে, সে প্রাণপনে তার সমস্ত বিদ্যা ঢেলেও নিধুবাবুকে সন্তুষ্ট করতে পারল না।
টাকা চাস তো? পাবি।
এবার হতাশ হয় কালীপদ। বলে, অ দা, বিশ্বাস গরন, ট্যাঁ পইচার কতা আঁর মনর ঢাগোদিও নাই।
বুঝতে পেরেছি, তুই আমাকে শিখাবি না, তবে কাকে শিখাবি? এসব গোপন বিদ্যা একজন না একজনকে তো দিয়ে যেতে হয়। গোপন বিদ্যার নিয়মই এটা।
দাদা বিশ্বাস করেন, আপনি না হয় ভেলার উপর আমার সাথে থাকেন, নিজের চোখে দেখেন সবকিছু… এটা কোনো গোপন বিদ্যা নয়।
কথা শেষ করতে দেন না নিধুবাবু। ‘ব্যচ, ব্যচ’ বললেন গম্ভীর হয়ে, ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলেন কালীপদের সামনে থেকে, পেছন ফিরে একবারও তাকালেন না, কালীপদ অন্ধকারের ভিতর আরো কোনো গভীর অন্ধকারে তলিয়ে গেল কিনা, তিনি তার নিজের সামনের অন্ধকার রাস্তায় টর্চের আলো ফেলে আর নিভিয়ে এমন ভাবে ঘরে ঢুকে গেলেন যেন তার সাথে কেউ ছিল না, তিনি অন্ধকারে একটু প্রস্তাব করতে গিয়েছিলেন ।
৭
কালীপদকে তার বন্ধুস্থানীয়রা বলে, তুমি তো দামি মানুষ হয়ে গেলে। এটাকে ঠাট্টা ভাবার কোনো কারণ নাই, কালীপদ তা ভাবেও না, আনমনে বসে সময় কাটায় ইদানীং, কখনো বা আফসোস করে আমি তো দামি মানুষ হতে চাই নাই। শুধু মানুষ, আর কিছু না। ভগবান, আমার সাথে যেন কারো শত্রুতা না হয়।
ক্রমশ আলাদা হয়ে যায় কালীপদ, একা একা পুকুরপাড় ধরে হাঁটে আর বিড়বিড় করে, কেউ ডাক দিলে চমকে যায়, দোকানে বা বাজারে বসে যখন সে আড্ডা দেয় পাড়ার লোক বা বন্ধুদের সাথে, তখনও যেন সে সেখানে অনুপস্থিত, ঠাট্টা করে কেউ জিজ্ঞাসা করলে, তোকে নিধুবাবু কী পরামর্শ দিল, তখন সে সত্যিই অসহায় হয়ে পড়ে। বলে, জাল বাওয়া ছেড়ে দেব।
৮
নিত্যানন্দ দত্ত খুবই খুশি। বলল, সাবাশ, এক বাপ’র পুত কালীপদ। নিধ্যুয়ারে যেই হলাউয়া দেহালি, এতাইল্লাই তোর উদ্দি আঁই বেশি খুশি। তোর অঙ্গে আঁর এক্কান পারচোনাল কতা আচিল।
ভেতরে ভেতরে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে কালীপদ, সে ইদানীং জানে, এর মানে কী। আদৌ কোনো আলাদা ক্ষমতা বা কৌশল নিজের ভিতর কখনো দেখে নাই সে, সে নিজেই ঠিকমতো জানে না, কীভাবে ছোটো ছোটো বুদবুদ ও ছোটো ছোটো ঘাই, পানির উপর তার মৃদু আলোড়ন, চিহ্নিত করে চোখের মাপে বৃত্ত এঁকে নিয়ে জাল ফেলামাত্রই তা ফল দেয়, দশজনকে বলে বেড়াচ্ছে তা, ছোটো হোক বড়ো হোক, সমাজের দামি মানুষ কমদামি মানুষ, যেই জিজ্ঞাসা করছে তার অলৌকিক দক্ষতার ভিতরকার রহস্য, সে তখনই ভা-ার উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে সব জ্ঞান, সেটাই ইদানীং হয়ে দাঁড়িয়েছে মুশকিল। কালীপদ জানে নিত্যানন্দ আরো কিছু শুনতে চায়, এমনকিছু যা সে কাউকেই বলে নাই। অথচ এমন কোনো কথাই তো কালীপদের নাই।
কালীপদ তাকেও বলে, দাদা এটা গোপন কোনো বিদ্যা নয়. স্বপ্নে পাওয়াও কিছু নয়; বিশ্বাস করেন, যা জানি আর মানি, সবই বলেছি। একটা অক্ষরও গোপন করি নাই।
এ হতা?
অ।
আর কিচু না?
না।
আঁরেও ন হবি?
নাইত অ দা, হইয়ুম কী।
নিত্যানন্দ চাপা গলায় বলে, নিজেকে খুব চালাক মনে করিস? আমার সাথে চালাকি করিস না, আমি পেটমোটা নিধু না, আমি নিত্যানন্দ দত্ত, আমার ডাকে শেয়াল মুতে।
সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নিত্যানন্দের দিকে। নিত্যানন্দের চেহারা কেমন বদলে যাচ্ছে; হাসি ও স্বর, বাতাস কেটে কেটে আঙুল ওঠানামার গতি, চোখের পাশের বলিরেখাগুলির টান, সব মিলিয়ে কালীপদের একটু ভয়ই লাগে প্রভাবশালী মানুষ নিত্যানন্দের বিরাগ ভাজন হয়ে।
অসহায় কালীপদ বলে, যদি চান তো জীবনে আর জাল ছোঁব না।
সেটাই করতে হবে, তোর জাল ছোঁওয়া জীবনের জন্য বন্ধ করে দিতে হবে। এই রায় নিত্যানন্দ দেয় ঠিকই, কিন্তু তাতেও যেন যথেষ্ট প্রশান্তি আসে না তার মনে, দুই পয়সার কালীপদ তাকে যেভাবে হেনস্তা করল, আধা পয়সার দাম দিল না, এর ফল এত অল্প নয়, চড়া মূল্য দিতে হবে তাকে।
৯
পরদিন নিধুবাবুর বাড়ি থেকে ডাক এল তার। এসেছে গোপাল, আরো আশ্চর্য, কাননবালাকে এড়িয়ে যাবার লক্ষণ তার মধ্যে নাই, এসেছে বুক ফুলিয়ে, উঠানে দাঁড়িয়ে বুড়িকে শুনিয়ে শুনিয়েই ডাকল, কালীপদ, কালীপদ।
মরা মাছের মতো ভাষাহীন চোখে কালীপদ বের হয়ে আসে, আমি ওসবে নাই, জাল আমি আর ছোঁব না। আমার শান্তি দরকার, শাপ লেগেছে আমার গায়।
উঠানের আরেক পাশে দাঁড়িয়ে কাননবালা বুকে ফুঁ দেয়। মা দুর্গা, মা দুর্গা। কিসের অভিশাপের কথা বলল কালি, সে জাল ছোঁবে না, এমন সংকল্প তো আশীর্বাদ, তবে এখানে অভিশাপের কথা আসে কোন তরফে, এসব কী বলে কালি!
বুড়ি এগিয়ে আসে, বলে, ‘অ হা’লি, কিয়র অভিশাফর হতা হদ্দে বাজি’?
না না, কিছু না, আমি জাল আর ছোঁব না, সে কথাই বললাম।
জাল ছুঁবি না ভালো কথা, সে তো ভগবানের আশীর্বাদ। অভিশাপ– কী বললি?
ও কিছু না, এমনি কথার কথা।
গোপাল বলল, বাবু তোমায় ডাকছে।
বুড়ি এগিয়ে যায় গোপালের দিকে, শুনলি না কালি জাল ছোঁবে না আর? ওকে আর না জ্বালিয়ে চলে যা।
জালের বিষয় নয়, অন্য কোনো সামাজিক বিষয়, এই যাবে আর আসবে।
কী বিষয়, কেন ডাকে?
আমিও ঠিক জানিনা মাসি।
অবশেষে যায় কালীপদ, বলে, জাল আঁই আর ছুইতাম নঅ।
খলবল করে হাসে নিধুবাবু, কেনরে? জাল কি তোর ভাসুর লাগে?
না দাদা, মস্করার কথা না, আমার মন উঠে গেছে, সবাই আমাকে ভুল বুঝছে, আমার ঘুম নষ্ট, শান্তি নষ্ট।
হুম? শান্তি নষ্ট? অনেক প্যাঁচাল পেরেছিস, নে জালটা ধর, দুইটা মাছ তুলে দে, একটা তুই নিস।
পাইত্তম নঅ।
অত্যন্ত বিরক্ত হয় নিধুবাবু। স্থির চোখে তাকায়, আপাদমস্তক পরীক্ষা করে কালীপদের, তার প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা মাপে, তার গোছমারা ছেঁড়া লুঙ্গি ও খালি গা ও খোঁচা খোঁচা সাদাকালো দাঁড়ি ও নারিকেলের শলার মতো আগোছালো গোঁফ নিয়ে যে কালীপদ তার সামনে দাঁড়িয়ে, তাকে কয় ধমকে কাবু করা যাবে মনে মনে হিসাব করতে থাকে নিধুবাবু। বলে, যা, মাছ পাবি না, পুকুরে নাম, জাল ছাড়াই আজ মাছ ধরবি, নইলে পুকুরে চুবিয়ে আজ তোকে গাছের সাথে বেঁধে রাখব। গোপাল, তপন, শশী, চান্দুরে খবর দে। বদনাম যখন হয়েছেই…
১০
নিত্যানন্দ দত্ত কালীপদের বাড়িতে চলে আসে, রাগে কাঁপছে সে, তার চেয়ে বেশি কাঁপছে ননী। আজ ননীও বুড়ির সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল।
নিত্যানন্দ বলল, অ হালি, আঁরে তোত্তে মানুষ মনে ন অয়? আঁই কি গরু ছ’ল না?
ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে কালীপদ, সে উঠানে এসে দাঁড়ায় হাত জোড় করে, তার পেছনে বউ সন্ধ্যারানী, সেও অবাক, বুড়ি কাননবালাও অবাক। তাদের অবাকের সীমা নাই, কালীপদ ভেতরে ভেতরে এ কোন রাজনীতির সাথে জড়াল কোনোই হদিস পায় না কেউই, না কাননবালা না সন্ধ্যারানী।
১১
দিনদশেক পর গ্রামবাসী অবাক হয়ে দেখল, খুবই সকালবেলা, হয়তো প্রথম যে বাইরে গেছে সেই দেখেছে প্রথমে, গ্রামেরই একটি পুকুরের কাছে পড়ে আছে কালীপদের নিথর দেহ। অর্ধেক শরীর ডুবে আছে পানিতে, দেহের বাকিটা পাড়ে শুয়ে টান টান হয়ে স্থির চোখে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। এ পুকুরের মালিক অনেকেই, অংশীদারিত্বের পুকুর এটি, ছুটে আসে সবাই, তাদের অতিপরিচিত কালীপদ এ কী কা- ঘটাল! সে যে মাছের সাথে কথা বলতো সবসময়, জনশ্রুতি চালু হচ্ছিল, মানুষের সাথে তার দূরত্ব বাড়ছিল ক্রমশ; সে এভাবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে, তার পরিবারকে অসহায় করে, পুকুরের পাড়ে অর্ধেক দেহ পানিতে ডুবিয়ে প্রাণ হারিয়ে শুয়ে আছে! তাজ্জব!
পুলিশ আসে, কানাঘুষা হয়, কার কার সাথে তার শত্রুতা ছিল এসব কথা জিজ্ঞাসা করে, গ্রাম ছেড়ে যেন কেউ না নড়ে তাও বলে, কোনো মানুষকেই খুনী হিসেবে শনাক্ত করার তাড়া তাদের ভিতর খুব কাজ করে; যেখানে মৃত্যুর কিছুদিন আগে গ্রাম্য রাজনীতি শিকার হয়ে তার নিধুবাবু ও নিত্যানন্দ দত্তের বিরাগভাজন হবার কথা তারাও জেনে গেছে। তবু অনেক অভিজ্ঞ গ্রামবাসী জানে, তার বউ, মা জানে সব মৃত্যু খুন নয়।
বুড়ি কাননবালা বুক চাপড়ে বিলাপ করে, তার ছেলেকে মাছে খেয়েছে। কিংবদন্তিতে পরিণত হতে যাওয়া কালীপদের এরূপ আচমকা জীবনাবসান, পাড়া মাতিয়ে তোলে, আলোচনা চলতে থাকে মাসের পর মাস।
কোনো কোনো মৃত্যু চিহ্ন রেখে যায়, কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু বা খুন, কালীপদ পাড়ায়, গ্রামে লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল, দিন দিন তার কাহিনি বিস্তৃত হয়ে উঠতে লাগল ফুলে ফেঁপে। তার বাড়ি বিখ্যাত হল, পাড়া বিখ্যাত হল, নাম ছড়িয়ে পড়ল দূর গ্রামেও।
১২
নিত্যানন্দ দাপুটে মানুষ, অনেক দাপুটে মানুষই রাতে একা বাইরে যায় না, তাদের অনেক নিয়মকানুন থাকে। তারা বাজারে যায় দল বেঁধে, আশপাশে কয়েকজন চামচা নিয়ে, সহযোগী বা স্তাবক নিয়ে। বাজারটা বাড়ি থেকে বেশ দূরেই, স্কুলের পাশে; কয়েকটা পুকুর, বিল, বাঁশঝাড় দ্ইু পাশে রেখে রাস্তা, অন্যান্য পাড়া; এরপর বাজার ও স্কুল। নিত্যানন্দ নিজ হাতেই বাজার করে, তার শখ ও প্রয়োজন, সাথে থাকে ননী।
ননী ও নিত্যানন্দ একদিন বাড়ি ফিরছিল সন্ধ্যার পর, বেশ পর, বাজারে আসর জমিয়ে আলোচনা বসাতে একটু দেরি হয়ে যায়, যদিও ‘বাজার’টা আগেই পৌঁছে গেছে বাড়িতে, নিত্যানন্দ এসে খাবে, খাওয়ার একটু আগেই ফেরে সে, এসেই খায়, প্রতি হাটবারে এ হল তার নিয়ম।
সেদিনও ফিরছিল, আগে ননী, হাতে টর্চ। একটা বাঁশঝাড়ের কাছে এসে ননী বলল দাদা যেন একটু এগিয়ে যায়, সে একটু বসবে। মানে প্রস্রাব করবে।
হাহ। আর সময় পেলি না। উষ্মা প্রকাশ করে একটু এগিয়ে যায় নিত্যানন্দ, হাতে টর্চ, চারিদিকে গভীর অন্ধকার ও ঠা-া বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ। হঠাৎ সামনের বাঁশঝাড়ে বিপুল আলোড়ন, যেন কেউ ঝাড়টি উপরে ফেলবে, টর্চটি জ্বালাবার সময় ও সুযোগও আর পায় না নিত্য, তার আগেই কেউ নাকি গলায় স্পষ্ট করেই বলল, মাঁঁছঁ ঁেদঁ।
গলাটা চিনতে পেরে নিত্যর প্রস্রাবের বেগ এসে যায় আর মুখটা হয়ে যায় হাঁ।
আবার যখন ‘মাঁছ ঁেদ হাঁরামজাঁদা, এঁকটি আঁছে, আঁরেঁকটি লাঁগঁবে…’ বলেই একটি বিশাল কাতলা মাছের লেজ ধরে শূন্যে ঘুরিয়ে এনে নিত্যানন্দের মাথায় মারে এক বাড়ি, নিত্য ‘বাবারে’ বলে অজ্ঞান হয়ে যায়। ততক্ষণে ছুটে এসে ননী দেখে যে নিত্য মুখে ফেনা তুলে গোঁ গোঁ করছে।
১৩
ঐ বাঁশঝাড়, এই বটগাছ তলা, ওই পুকুরের পাড়, এ দিঘির ধার, রাতের দিকে ঐ নাকি গলায় মাছের দাবি অনেকেই শুনতে শুরু করে। বাজার থেকে মাছ কিনে ফিরতে থাকা লোক, রাতে প্রস্র্রাব করার জন্য বাইরে যাওয়া লোক, মধ্যরাতে অন্যের পুকুরে মাছ চুরি করতে যাওয়া লোক, বাদ যায় না কেউই, রাত একটু গভীরের দিকে গেলেই নাকি গলার আওয়াজ আসতে থাকে, মাঁছ দেঁ।
ভীরু স্বভাবের কেউ কেউ মাছ ফেলে দৌঁড়ায়, বাড়ি এসে মাছবিহীন মাছের ঝোল রেঁধে খায়. দলবিহীন হয়ে রাতের দিকে অজায়গায় যাওয়া কমে যাচ্ছে সবার, মোড়ে মোড়ে আলোচনা শুরু হয়, কিনারা পায় না গ্রামবাসী, এমনকী যেদিন রাতে নিধুবাবু বাইরে প্রস্রাব করতে এসে কি যেন দেখেই প্রস্র্রাব না করে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে দুই হাত শূন্যে তুলে মা মা বলতে বলতে অবশেষে বাচ্চাদের প্রস্র্রাব করার ডাবরে কাজ সারে, সেদিনই সবাই নিশ্চিত হয়ে যায়, নাকি সুরে মাছ চাইছে আর কেউ নয়, স্বয়ং কালীপদ।
নিত্যানন্দ প্রথম দিনই বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু ভয়ে নামটা মুখে আনে নাই, এখন সবার মুখে মুখে। ঘরে ঘরে সন্ধ্যার পর পরই আতঙ্কের সাথে নামটা ফিসফিসিয়ে বলা হতে থাকে পরস্পরকে, এমনকী শিশুরা বিরক্ত করলে ‘ঐ আসছে কালীপদ’ বলে তাদের ঠা-া রাখার ফলদায়ক কৌশল নেয়া হতে থাকে, এখন লোকেরা মেছোভূত কথাটাও আর বলে না, বলে, কালীপদ।
সবচেয়ে বেশি ঘাবড়ে গেছে নিধুবাবু, সে না কি এখন দিনেও ‘মাঁছ দেঁ’ শুনছে একা থাকলেই, ভয়ে সে একা থাকে না, সবসময় সাথে রাখে কাউকে এমনকী যখন পায়খানায়ও যায়, গ্রামের পায়খানাগুলি একটু দূরে হয় ঘর থেকে, তখন কাউকে দাঁড় করিয়ে রাখে বাইরে, তাকে অনবরত কথা বলতে হয় নাকে হাত চেপে ধরে, যাতে কথার ঠাস বুনটে ‘মাঁছ ঁেদ’ বা অন্য কোনো কথা ঢুকে পড়তে না পারে। তাবিজে কবজে নিধুর হাত ভরে গেছে, সবসময় মুখ কাঁদো কাঁদো। কালীপদ এখনো কারো ঘাড় মটকায় নাই, কেউ কেউ না কি স্বপ্নেও দেখেছে তাকে, অন্তত একজন গ্রামবাসীর মাথা চিবাবে সে, নইলে না কি তার আত্মার শান্তি নাই। সে কে? কার মাথা? সে কথা কালীপদ বলে নাই।
শুনে নিত্যানন্দের ঘুম বরবাদ হয়ে যায়। বলে, ছাগল বলি দে, মোষ বলি দে, কালীপদের অতৃপ্ত আত্মাকে তুষ্ট কর…
১৪
এসব কিছু কিছু কথা কাননবালার কানে আসছিল। হঠাৎ সে কোনো একটি ঘটনা শোনে, ব্যথার ঢেউ ঘাই মারে বুকে; যদি সময় থাকে, বাপধনরে বলে শুকনো বিলাপ করে খানিক। যা হয়, সময়ের ঔষধে সব শোকেই প্রলেপ পড়ে, ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে শোক, তাজা ভাবটা পেতে পরিবেশের আনুকূল্য লাগে, সব মিলিয়ে জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত বুড়ি, অসময়ে অসহায় করে ফেলে চলে যাবার জন্য বিলাপের মধ্যে ক্রোধও ঝাড়ে কালীপদের প্রতি। বলে, কালীপদ কতবড়ো অমানুষের মতো কাজ করেছে, তিন তিনটা বাচ্চা, বউ আর বিধবা মাকে ফেলে হুট করে যে স্বর্গে চলে গেল এ কেমন ন্যায়বোধ, কেমন বিবেচনা। কীজন্য পেটে ধরেছিল তাকে? এমন কুপুত্রকে?
বুড়ির এসব গুনগুনানিতে কালীপদ যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে, এমন জীবন্ত যেন কেউ হঠাৎ করে শহর থেকে বা দূর গ্রাম থেকে এসে বলবে, কোনো বিশেষ কারণে না বলে চলে যেতে হয়েছে কালীপদকে, কয়েকদিনের মধ্যেই এসে পড়বে।
যখন কালীপদের বউ যায়, লোকে বলে, ঐ তো কালীপদের বউ। যখন বাচ্চারা যায়, বলে, কালীপদের ছেলে।
এদিকে নিত্যানন্দ, নিধুবাবু আরো কার কার যেন রাতে প্রস্রাব পায়খানা বন্ধ হয়ে গেছে। রাতের শখ, বাইরে থাকা বা যাওয়ার শখ মিটে গেছে, মৃত্যু যেন কালীপদের চেহারা নিয়ে সবসময় কাছে কাছে ঘুরছে, একলা অন্ধকারে পেলেই ‘মাঁছ ঁেদ’ বলে দেবে এক মরণকামড়।
১৫
খুব সকালে বুড়ির ওঠার অভ্যাস, গত পঞ্চান্ন বছর ধরে, শরীর যদি খুব খারাপ করে ভিন্ন কথা, তবে বুড়ির শরীর সচরাচর খারাপ করে না, তাই নিয়মের ব্যত্যয়ও হয় না। সেদিন গোবর ছিটা দিয়ে আলো আঁধারি সকালে মাত্র ঝাঁটা হাতে নিয়েছে; বুড়ি তাজ্জব হয়ে দেখে, মানী লোক নিত্যানন্দ কাঁচুমাচু হয়ে তার সামনে দাঁড়ানো।
বুড়ি ঠাহর করে দেখার জন্য এগিয়ে গিয়ে দেখতে পায়, করুণ চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে সে। কাননবালা বুঝি প্রশ্ন করার ভাষাও হারিয়ে ফেলে, শুধুই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
কথা বলে ওঠে নিত্যানন্দ, বলে, মাসি, অ মাসি, কালিপদঅ ত আঁরে শেষ গইল্ল।
আজ আর কালীপদের কথা শুনে বুড়ির শোক উথলে ওঠে না বরং কোনো এক শক্তিশালী কালীপদের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য তার কাছেই শরণ নিতে আসা নিত্যর লুটিয়ে পড়া মূর্তিটি উপভোগ করে সে।
নিত্য আবার বলে, কালীপদ আমাকে ঘরের বাইর হতে দেয় না।
বুড়ি মাথা নাড়ে, কিছুই বলে না।
মাসি আমাকে বাঁচান মাসি।
আঁই ক্যাং গইজ্জম?
কালীপদকে একটু মানা করে দেন যেন আমাকে মাফ করে দেয়। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না ভয়ে।
উঠানে বুড়ি ও নিত্য। চারিদিকে কেউ নাই, ঘরের ভিতরকার কেউই এখনো ঘুম থেকে ওঠে নাই। ভয়ে কাঁচুমাচু নিত্য সাক্ষী না রাখতে অথবা বায়ু দোষে অতি ভোরে সংবাদ নিয়ে একাকী হাজির হওয়ার মাহাত্ম্যের চেয়ে কালীপদের শক্তি বুড়িকে অবাক করে দেয়। এই শক্তিমান কালী কোথায় কীভাবে চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে বুড়ি হাতড়ায়। চট করে কোনো জবাব দেয় না, শুধু মাথা নাড়ে।
মাসি, আবার বলে নিত্য, কাল রাত্তিরে… , বলতে বলতে কেঁদে ফেলে সে, বলে, বিশ্বাস যাবেন না মাসি, ভেউ ভেউ করে নিত্য কাঁদতে থাকলে বুড়ির মনে যথেষ্ট করুণার উদয় হয় এবং বিরক্ত হয়ে ওঠে কালীপদের উপর। ভাবে, এ মাটির মানুষটাকে ভয় দেখানো কালীর উচিত হচ্ছে না আদৌ, আহারে বেচারা, না ঘুমাতে না ঘুমাতে মুখটা শুকিয়ে একেবারে আমপাতা হয়ে গেছে।
মাসি, কালীকে একটু মানা করে দেন মাসি, আপনি ছাড়া আর কারো কথা শুনবে না সে।
নিত্য বিদায় নিলে বুড়ি অবাক হয়ে ঝাঁটাটা ফেলে ভাবতে বসে, কালীপদের এ কী কারবার, দুনিয়ার লোককে সে দেখা দিয়ে বেড়াচ্ছে, বদমাশ কুপুত্র, তোর এই বুড়া মাকে একবারও মনে পড়ে না? গজ গজ করতে থাকে বুড়ি। সন্ধ্যারানী উঠে এসে বুড়ির মুখে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শোনে আর বাসি উঠান দেখে নিজেই ঝাঁটাটা তুলে নেয় হাতে।
একদিন নিধুবাবু এল।
অভিযোগের পাল্লা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠলে বুড়ি ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে ওঠে কালীপদের উপর। ভাবে, এটা ঘোর অন্যায়। নিজের গ্রামের মানুষের প্রতি কিছুটা মমতা থাকা উচিত বদমাশটার।
১৬
একদিন সন্ধ্যার পর সন্ধ্যারানী অবাক হয়ে দেখে বুড়ি কেমন যেন চুপচাপ, সাড়া নাই। হাঁটছে, ঘুরছে, দাঁড়াচ্ছে, তবু যেন চুপচাপ, সাড়া নাই। আর মুখে মিট মিট হাসি।
রাত একটু গভীর হলে বুড়ি বলল, আজ অন্ধকার একটু কম, ‘অ বৌ… দরজা খোলা রাইচ, বাআ’রে যাইয়ম এক্কেনা’।
বাইরে কেন? কোথায়? এমন রাতের বেলা?
সে কথার আর জবাব দেয় না সে। সন্ধ্যারানীও অপেক্ষা করতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর সে দেখে বুড়ি একটা মাছ বের করল, না রেঁধে কোথায় যেন লুকিয়ে রেখেছিল। মাছটা হাতে নিয়ে মিটমিট হেসে বেড়িয়ে পড়ল বাড়ি থেকে, তাজ্জব সন্ধ্যারানীও গেল পিছু পিছু, যাতে বুড়ি কিছুই টের না পায়।
বুড়ি হাঁটছে হন হন করে, সোজা গেল বাঁশঝাড়ের কাছে, সন্ধ্যারানীও পিছু পিছু। বুড়ি বলে উঠল, অ হালিপদঅঅ… হালিপদঅঅ… হডে গেলি… আঁই আসসি ত অ পুত…
সন্ধ্যারানীর সারা গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। বলে ওঠে, রাম রাম।