যে কারণে আরব বিভক্ত, সে কারণেই ইসরায়েল শক্তিশালী : ড. সলিমুল্লাহ খান
প্রকাশিত হয়েছে : ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ
[প্রাবন্ধিক, গবেষক ও অনুবাদক। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের অধ্যাপক। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউ স্কুল ফর সোস্যাল রিসার্চ, নিউইয়র্ক। ছাত্রাবস্থায় ‘প্রক্সি জার্নাল’ বের করে সমাদৃত হন। সাম্প্রদায়িকতা, রোহিঙ্গা ইস্যু, ভারত ভাগসহ নানা বিষয়ে তার অনেক নিবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। ফিলিস্তিন বিষয়ক নানা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ হয় অষ্টপ্রহরের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা]
ফিলিস্তিনের বিখ্যাত কবি হিসেবে পরিচিত মাহমুদ দরবেশ মারা গেছেন ২০০৮ সালে। ১৯৪২ সালে তাঁর জন্ম, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলিরা হামলা শুরু করে, ব্রিটিশরা দেশটি ত্যাগ করল, জাতিসংঘ দেশটি দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব গ্রহণ করে— তার সমসাময়িক সময়ে। এটাকে ফিলিস্তিনের ইতিহাসে বিপর্যয়, মহাযজ্ঞ হিসেবে দেখা হয়। সে সময়ে মাহমুদ দরবেশের বয়স ছয় বছর। তাদের গ্রামেও ইসরায়েলিরা এসে উত্খাত করল। ইসরায়েলের আক্রমণের ইতিহাস, তাঁর জীবনেরও ইতিহাস বটে। দুজন সবচেয়ে বিখ্যাত ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবীর নাম নিলে— এডওয়ার্ড সায়ীদ এবং মাহমুদ দরবেশের নাম নিতেই হয়। দরবেশ জীবনের শেষভাগে একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটির মৌখিক অনুবাদ আমি উপস্থাপন করছি। কবিতার শিরোনাম— বালিকা/চিৎকার। গল্পটা হচ্ছে এ রকম: সমুদ্রের তীরে একটি বালিকা, বালিকার একটি পরিবার আছে। পরিবারের একটি বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে একটি দরজা ও দুটি জানালা আছে। কতখানি গরিব তা সহজেই বুঝতে পারছেন। এটা গাজার কথা। সমুদ্রের মধ্যে দেখা যাচ্ছে একটি যুদ্ধজাহাজ। সেখান থেকে গুলি ছুড়ছে। আর সমুদ্রতীরে তারা কয়েকজন বাতাস খাওয়ার জন্য হাঁটছিলেন। হঠাত্ করে মেয়ে দেখল, তার সামনে জাহাজ থেকে ছোড়া গুলিতে চারজন, পাঁচজন, সাতজন পড়ে গেল। মেয়েটি চিৎকার করে উঠল। সেখানে তার বাবাও ছিল। মেয়েটি বাবাকে ডাকে, কিন্তু তিনি সাড়া দেন না। সে দেখল, বাবার গায়ে রক্ত। মেয়েটি দেখল তার হাতে রক্ত, মেঘের মধ্যে রক্ত। মেয়েটি চিৎকার করা শুরু করল। সাংবাদিকরা এ চিৎকার ধারণ করলেন। এটাকে তারা নাম দিয়েছেন ব্রেকিং নিউজ। মেয়েটি চিৎকার করে তার বাড়ির দিকে আসা শুরু করল। সে দেখল, হঠাত্ করে একটি বোমারু বিমান এসে তার বাড়িটি ধ্বংস করল। আমি মনে করি, এটি কবির দুর্ঘটনাক্রমে লেখা নয়। গাজায়-ফিলিস্তিনে নিত্যই এটি ঘটছে এবং সর্বশেষ যে ঘটনা ঘটছে তা এরই সংস্করণ মাত্র। বলতে পারেন, পরিমাণগতভাবে হয়তো হত্যা বেশি হচ্ছে। গুণগতভাবে এ ঘটনা ঘটছে বলে কবির কল্পনায় এভাবে এসেছে এবং কবি খুব বেশি দূর কল্পনা করেননি।
এখানকার পরিস্থিতি তৈরির পেছনের কারণগুলো সম্পর্কে একটু বলবেন?
মনে রাখতে হবে ফিলিস্তিনিরা একটি জনগোষ্ঠী। দুর্ভাগ্যবশত তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র নেই। তারা বহুদিন ধরে লড়াই করছে। অনেক আগের লড়াই বাদ দিলে দেখা যায়, ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তারা লড়াই করেছে। এটাকে তাদের লড়াইয়ের প্রথম পর্ব বলা যায়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত তাদের ব্যাপক কোনো সংগঠন ছিল না। প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) গঠিত হয় ১৯৬৪ সালে। এটিকে তাদের সংগ্রামের প্রথম পর্ব বলা যায়। এ পর্বে তারা নির্ভর করেছিল আরব রাষ্ট্রের সাহায্যের ওপর। নিজেরা নিজেদের বাহিনী গঠন করেনি। এর মধ্যে ইয়াসির আরাফাতের উত্থান হলো। একটা নতুন নেতৃত্ব, যুগ শুরু হলো। ইয়াসির আরাফাত পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি কাতারে-কুয়েতে অন্যান্য জায়গায় থাকার সময় সংগঠন এবং তারপর আন্দোলন শুরু করেন। সে আন্দোলনের প্রক্রিয়া ছিল কমান্ডো বাহিনী গড়ে তোলা। তখন তারা বিমান ছিনতাই থেকে শুরু করে অনেক কাজ করেছিল। সেটাকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বলে ইসরায়েল নিন্দা করার সুযোগ পেয়েছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে মিসর কিছুটা হলেও পরাজিত হলো। এ পর্বের পর ফিলিস্তিনিরা লড়াইয়ে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত টিকেছিল। ইসরায়েল লেবাননে হামলা করে সেখান থেকেও তাদের তাড়িয়ে দিল। তখন ফিলিস্তিনিদের মাঝে নতুন উপলব্ধি এল— ইসরায়েলের সামরিক শক্তির সঙ্গে তারা টিকতে পারবে না। এক্ষেত্রে আমার অভিমত হলো, তাদের কৌশলটি ছিল ভুল। এ রকম পরিস্থিতিতে কমান্ডো বাহিনী দিয়ে পারা যায় না; এক্ষেত্রে দরকার জনগণের ভেতর থেকে উত্থিত বিপ্লবী গেরিলা। অবশ্য এটা পরে তাদের উপলব্ধিতে এসেছে। এতে একটি গণ্ডগোল হয়েছে, তারা অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বাইরে চলে গেছে; তারা তখন নির্বাসিত হয়েছে। নির্বাসিত নেতৃত্ব এবং অধিকৃত এলাকার জনগণের মাঝে ব্যবধান তৈরি হলো। তখন অধিকৃত জনগণ কম ছিল না, ত্রিশ লাখের মতো। আর এখন সেখানে চল্লিশ লাখের মতো জনগোষ্ঠী। সেজন্য তারা দ্বিতীয় উপলব্ধিতে এল। এর নাম হলো ইন্তিফাদা। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্তিফাদা বা গণঅভ্যুত্থান শুরু হয় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে, প্রকারান্তরে সেটি ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও বটে। তখন অধিকৃত এলাকার জনগণ নিজেরাই নিজেদের আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, আর তারা পিএলওর ওপর পুরোপুরি নির্ভর করছিলেন না। এটা হচ্ছে ভেতরের কথা। তবু ইয়াসির আরাফাতের আধিপত্য ছিল বলে তিনি তার বাহিনীর সদস্যদের বোঝাতে সমর্থ হন যে, এই ইন্তিফাদার পথেই তাদের চলতে হবে। এজন্যই তারা ইসরায়েলের দাবি অনুসারে ইসরায়েলকে স্বীকার করে নিল। একই সঙ্গে ইসরায়েলের ভেতরে থেকেই স্বাধীনতা আদায়ের পথ নিল; বাইরে থেকে আক্রমণ করে এটা অর্জন করা যাবে না, এটা বুঝে গেল। সহজভাবে বললে এরই নাম ইন্তিফাদা। তখন পৃথিবীতে একটি টালমাটাল অবস্থা। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাচ্ছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক মেরুর বিশ্ব আবর্তিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিলে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তিতে সম্মত হয়। এ চুক্তির নাম অসলো শান্তিপ্রক্রিয়া। এ সিদ্ধান্ত পিএলওকে নিতে হয়েছে। প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল কাউন্সিল নামে তাদের আরেকটি সংস্থা আছে। সেটি পিএলওর সদস্য এবং সদস্য না— উভয় ধরনের ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত। যেমন— মাহমুদ দরবেশ, এডওয়ার্ড সায়ীদ এবং ইব্রাহীম আবু লুঘদের মতো বুদ্ধিজীবীরা ওই সংস্থার সদস্য ছিলেন।
আগে তো তারা একটা রাষ্ট্র চেয়েছিলেন, পরে দুটি রাষ্ট্র মেনে নিলেন। এর পেছনে তাদের কি যুক্তি ছিল?
১৯৯৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বিল ক্লিন্টনের নেতৃত্বে হোয়াইট হাউসে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দুই প্রতিনিধি একটি কাগজে স্বাক্ষর করেন। ওই কাগজটির নাম হলো ডিক্লারেশন অব প্রিন্সিপালস (ডিওপি)। এটা মোটেই শান্তি চুক্তি ছিল না। এর মাধ্যমে ইসরায়েল প্রতিশ্রুতি দিল তারা ফিলিস্তিনকে স্বীকার করে নেবে। এটাকে বলে অসলো শান্তিপ্রক্রিয়া। ১৯৯১ সালে অসলোয় একটা ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন তারা। দুই বছর পর নেতৃবৃন্দ যুক্তরাষ্ট্রে আবার একত্র হলেন। এর পরিণতিতে ফিলিস্তিনসহ বিশ্ব সম্প্রদায় আশা করেছিল, ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে স্বীকার করে নেবে। যদিও ওই চুক্তিতে কোথাও তারা ফিলিস্তিনিদের জাতীয় অধিকার স্বীকার করেনি; বরং তারা ‘লেজিটিমেট রাইটস অব প্যালেস্টিনিয়ান পিপল’-এর কথা বলেছে। তারা কখনো ফিলিস্তিনিদের জাতি হিসেবে স্বীকার করেনি এবং এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয়নি। বর্তমান সংঘাতের গোড়ার কথাই আমি বলছি। এক্ষেত্রে আমি দুটি কথা বলব। একটি ইসরায়েলের দিক থেকে; অন্যটি ফিলিস্তিনের দিক থেকে। ইসরায়েলের দিক থেকে গোড়ার কথা হলো, তারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের সীমা এক ইঞ্চি ইঞ্চি করে বাড়াতে চায়। খেয়াল করা দরকার— ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ইসরায়েল কখনো ন্যাশনাল রাইটস এবং অকুপায়েড টেরিটরি শব্দ ব্যবহার করেনি। গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাংক— এ দুটি কথা ব্যবহার করে। এখনো বিশ্বব্যাংকের দলিলে লেখে— ডব্লিউবিজি (ওয়েস্ট ব্যাংক অ্যান্ড গাজা)। গাজা এলাকা অপেক্ষাকৃত ছোট, ওয়েস্ট ব্যাংকটা বড়। দুটিই ফিলিস্তিন ভূখণ্ড। চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছে, এটাকে আমরা মনে করছি বিরাট বিজয়। এর কোথাও তারা ফিলিস্তিনি জাতীয় রাষ্ট্রকে স্বীকার করেনি এবং কত তারিখের মধ্যে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা দেবে তা-ও বলেনি। কেবল বলেছে, মাত্র প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর মধ্যে তারা বলেছে, গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাংক থেকে সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করবে; কিন্তু সেখান থেকে বসতি স্থাপনকারীদের প্রত্যাহার করবে কিনা, তা বলেনি। এ কারণে এডওয়ার্ড সায়ীদ, ইব্রাহীম আবু লুঘদ এবং মাহমুদ দরবেশ, ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, এ শান্তি চুক্তিতে আমাদের কোনো লাভ হবে না। কেননা যতই ছোট হোক, একটি রাষ্ট্র এবং এর সন্নিহিত এলাকাকে অবশ্যই অবিচ্ছেদ্য হতে হবে। কিন্তু মাঝখানে মাঝখানে ছিটমহলের মতো ইসরায়েলি কলোনি থাকলে কখনো একটি রাষ্ট্রকে ভালোভাবে শাসন করা যাবে না। তখন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলা হয়েছিল, যতই ছোট হোক ফিলিস্তিন যদি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়, তবে তা হবে মধ্যপ্রাচ্যের সিঙ্গাপুর। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে দেখা গেছে, এটা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার সুয়েটোর মতো। একই সঙ্গে বান্তুস্থান। বর্তমান সংঘাতের প্রথম দিকটা হলো এটুকুই।
এখনকার সংঘাত শুরু হয়েছে ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। আপনি নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, তারা একটা বাহানা করেছে। তিনজন ইসরায়েলি যুবক অপহূত ও নিহত হয়েছে, তাদের লাশ পাওয়া গেছে। হামাস কখনো বলেনি তারা এটা করেছে, তারা এর দায়িত্ব নেয়নি। কোনো রকম তদন্ত না করে, কোনো কমিটি না করে ন্যূনতম প্রমাণ ছাড়াই ইসরায়েল যে আক্রমণ শুরু করল, তা চরম অন্যায়। এতে বোঝা যায় পরিকল্পনাটি পূর্ণ করেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা। আমি পরিষ্কার করে বলব, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যে বা যারাই করুক— আক্রমণ করার জন্যই ওই তিন যুবককে অপহরণ করা হয়েছিল। সুতরাং আক্রমণ করার উদ্দেশ্য হলো, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে দুর্বল করা; বিলম্বিত করা এবং আরো জায়গা দখল করে তাদের আধিপত্যকে স্থায়ী করা।
গাজা এলাকার প্রধান শক্তি হিসেবে খ্যাত হামাস মোটামুটি ফিলিস্তিনি জনগণের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে। হামাস হিসাব করেছে, তারা যদি প্রতিরোধ না করে, তাহলে বাকি ভূমিটুকু হারাবে। অবশ্য বলা হচ্ছে তারা যুদ্ধ করছে। আদতে তারা যুদ্ধ করছে না; কেবল প্রতিরোধ করছে। এটা নিছকই প্রতিরোধ-সংগ্রাম। ইসরায়েল যেটা করছে তাও যুদ্ধ নয়। এটা হচ্ছে আগ্রাসন; দমননীতি। ফিলিস্তিনি জনগণের দিক থেকে এটিকে বলা যায়, জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টা। পৃথিবীর মানুষের কাছে স্বীকৃতি পেতে ফিলিস্তিনিদের শেষ অস্ত্র হচ্ছে তাদের প্রাণ। ইরানি শিয়াদের মতো একসময় ফিলিস্তিনিদের মধ্যেও জেহাদি জোস এসেছিল, আত্মদানের জোস; যাকে আমি বলেছিলাম আদমবোমা। ইংরেজিতে যাকে বলে সুইসাইড বম্বিং। আমি ব্যক্তিগতভাবে আদমবোমাকে সমর্থন করি না। কিন্তু ইতিহাসের নিরিখে আমাদের বুঝতে হবে মানুষ কখন নিজের প্রাণকে তুচ্ছ করে দিতে চায়; এর ঐতিহ্য শিয়াদের মধ্যে আছে। কিন্তু আমি যখন ফিলিস্তিনে এ বিষয়টি দেখেছি, তখন আমার পক্ষে একটি মত দেয়া সম্ভব; কিন্তু ঘটনা তো শেষ করা সম্ভব না। তাই আমি বলব, ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মরক্ষার সব রকম চেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়, তখন তারা আত্মদান করে। বর্তমানেও হামাস যেটা করছে তা অনেকটা সুইসাইডাল অর্থাত্ জয়ী হওয়ার মতো শক্তি তাদের নেই অথচ লড়ছে। পৃথিবীর কাছে এর কোনো বার্তা নেই?
এক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকাকে কীভাবে দেখেন?
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৪৮ সালে ১৮১ নং প্রস্তাবের (পার্টিশন অব প্যালেস্টাইন) মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে দ্বিখণ্ডিত করে। কিন্তু ফিলিস্তিনি আরব, খ্রিস্টান এবং স্বল্প সংখ্যক ইহুদিরা নিজেদের মাতৃভূমির এ খণ্ডন পছন্দ করেনি। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের চেয়ে এটি ছিল আরো নৃশংস। এজন্য নিজ দেশের জনগণ তা মেনে নেয়নি। অবশ্য ইসরায়েল এটা মেনে নিয়েছিল। এর কারণ, তাদের অধিকতর বড় অংশটাই প্রদান করা হয়। মোট ফিলিস্তিনকে বিভাজন করে ইসরায়েলকে অর্ধেকেরই বেশি দেয়া হয়। ফিলিস্তিনিরা এটা মানেনি। তখন তাদের মধ্যে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধের বিপদ হলো, ফিলিস্তিনের ভেতর থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধটা দুর্বল হওয়ায় আশপাশের চারটি আরব দেশ তাদেরকে আক্রমণ করে। অপ্রস্তুতি, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বিধাগ্রস্ততা, সামরিক দুর্বলতায় তারা পরাস্ত হয়। তখন ইসরায়েল যে কাজটি করেছিল এখন তা-ই করছে। এটাকে বলে পোড়ামাটিনীতি অর্থাত্ ফিলিস্তিনের বিভিন্ন গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে, বাড়িঘর উচ্ছেদ করে, গুলি করে হত্যা করে বিতাড়িত করে তারা জায়গা দখল করেছে। তখন আরব নেতারাও একটি বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন— ফিলিস্তিনিদের বলেছিলেন তারা যেন ভূখণ্ড ছেড়ে বাইরে চলে আসে। এর পর ফিলিস্তিনিরা জর্ডানে আশ্রয় নেয় এবং বিভিন্ন জায়গায় তারা পালিয়ে গেল। এর নাম ছিল ফিলিস্তিন শরণার্থী সমস্যা অর্থাত্ আরব নেতাদের পরামর্শে এবং ইসরায়েলের আক্রমণের ভয়ে অনেক ফিলিস্তিনি তাদের অধিকৃত এলাকা ছেড়ে বাইরে চলে যায়। ফলে ইসরায়েল আরো বৃহত্ এলাকা দখল করে নেয়।
তখন জাতিসংঘ কি ব্যবস্থা নিয়েছিল? এক্ষেত্রে জাতিসংঘের ব্যবস্থা ছিল প্রস্তাব গ্রহণের মধ্যে সীমিত। জাতিসংঘ বরং তখন ফিলিস্তিনিদেরই দোষারোপ করল তারা কেন পালিয়ে গেছে। ১৯৬৪ সালে পিএলও গঠিত না হওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপ ছিল। ইয়াসির আরাফাতরা যখন ১৯৫৮, ১৯৫৯ সালের দিকে আল ফাতাহ গঠন করে, তখন পর্যন্ত জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে স্বীকার করেনি। তাদেরকে জাতিসংঘ বলত আরব রিফিউজিস। জাতিতে আরব হলেও তারা তো রাজনৈতিকভাবে ফিলিস্তিনি। সেটি জাতিসংঘ ভালো করে স্বীকার করেনি। এর পর ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর নিরাপত্তা পরিষদে আবার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ যুদ্ধে ১৯৪৮ সালের বিভাজনে ফিলিস্তিনিদের স্বীকৃত এলাকাও ইসরায়েল দখল করে নেয়। আরবরা পরাজিত হলে ওই যুদ্ধে ইসরায়েল জর্ডানকে পরাজিত করে পশ্চিম তীর দখল করে নেয় আর সিনাই উপকূলের দিকে যুদ্ধে করে মিসরকে পরাজিত করে গাজাও দখল নেয়। অর্থাত্ যে অংশটুকু আগে ইসরায়েলের দখলে ছিল না তা-ও তারা দখল করল। এটিই হচ্ছে যুদ্ধে অধিকৃত অঞ্চল। এর পর জাতিসংঘ প্রস্তাব করে ইসরায়েল যেন সেখান থেকে সরে যায়। অর্থাত্ জাতিসংঘ বলেছে, ’৬৭ সালের যুদ্ধের পর যেটুকু অংশ দখল করেছিল তা যেন ইসরায়েল ছেড়ে দেয়। ১৯৪৮ সালের বিভাজনের পর যে অংশটুকু ইসরায়েল দখল করেছে, সেটি প্রকারান্তে স্বীকার করে নেয় জাতিসংঘ। ১৯৭০ দশকের শুরু থেকে এ কথাগুলো চলছিল। ইসরায়েলও গোপনে বলছিল যে, তারা ফিলিস্তিনিদের আলাদা রাষ্ট্র করে দেবে। কিন্তু সেখানে একটি জিনিস অস্পষ্ট থেকে যায়, সীমান্তটা কি হবে? জাতিসংঘ যে বর্ডার নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল, তাতে ইসরায়েল রাজি না। পরে জাতিসংঘ ওটা প্রত্যাহার করে বলে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ যা দিয়েছিল এবং ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগে যা ইসরায়েল দখল করেছিল দুটোই বৈধ। তবে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময় বা পরে যে এলাকাটুকু দখল করা হয়েছে তা ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করে জাতিসংঘ। এটাকে বলে অকুপায়েড টেরিটরি। এক্ষেত্রে ইসরায়েলের কৌশল হলো, এ অকুপায়েড টেরিটরির মধ্যেও বসতি স্থাপন করা এবং বর্তমানে তারা তাই-ই করছে। সেখানে তারা কি হারে জায়গাটা দখল করছে, তার একটি তথ্য দিলেই বোঝা যাবে। ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সাত বছরে কেবল পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরায়েলি সেটলারের সংখ্যা ১ লাখ ১০ হাজার থেকে বেড়ে ১ লাখ ৯৫ হাজার হয়েছে। এ হার প্রায় ৭৭ শতাংশ। ১৯৬৭-৯৩ এর মধ্যে প্রতি বছর ইসরায়েলিরা পশ্চিম তীর ও গাজায় ৪ হাজার ২০০টি করে বাড়ি স্থাপন করেছে। ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে প্রতি বছরই সে সংখ্যা হয়েছে ১২ হাজার। ইসরায়েলে খাইম ওয়াইজম্যান নামে একজন বিখ্যাত নেতা ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইসরায়েলের সংগ্রামটা হলো প্রতিদিন এক একর জায়গা দখল করা, গবাদিপশু কেড়ে নেয়া। এটাই তাদের ক্রমসম্প্রসারণের রূপ। আরেকটি তথ্য দিলে ইসরায়েলের জমি দখলের হিসাবটা পরিষ্কার হবে। তথ্য বলছে, ১৯৯৯ সালে ইসরায়েল প্রায় ১০ হাজার একর জমি দখল করেছিল। প্রতি বছর এ হার বাড়ছে। এখন ২০১৪ সাল। তারা যদি আগ্রাসন চালিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়া আরো বিলম্বিত করতে পারে, তবে অনেক জায়গা দখল করতে পারবে। অর্থাত্ ফিলিস্তিনের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে তারা জায়গা কেড়ে নিচ্ছে। যে আরব অধিবাসীদের তারা তাড়িয়ে দিচ্ছে, সেখানে ইহুদি বসতি না পেয়ে ইথিওপিয়া, পেরু লিমা এমনকি ভারতের মিজোরাম থেকে ইহুদিদের নিয়ে আসছে। এ থেকে প্রমাণ হয়, বর্তমানে সংঘাত জিইয়ে রাখার বাহানা যা-ই হোক, এর প্রধান উদ্দেশ্য ইসরায়েলি বসতিকে আরো সম্প্রসারণ করা এবং ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের তাড়িয়ে দেয়া। ফিলিস্তিনিদের দু’ভাবে তাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। একটি হলো হত্যা করে, অন্যটি ভয় পাইয়ে। এটা ১৯৪৮ সালে করে তারা সুযোগ পেয়েছে, ১৯৬৭ সালে সুযোগ পেয়েছে, এখনো তা-ই করছে।
এ প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিন যদি পুরোটাই দখল হয়ে যায়, তাহলে কি ইসরায়েল পার্শ্ববর্তী দেশগুলো দখল করবে?
সেটা বলা মুশকিল। অন্তত বর্তমান রাষ্ট্রের নেতারা সেটা প্রকাশ্যে বলছে না। আবার এটা অসম্ভবও নয়। অবশ্য তাদের আদি নেতা থিওডর হার্জেল ১৯০৪ সালে ঘোষণা করেছিলেন, বৃহত্তর ইসরায়েল রাষ্ট্র। এর সীমানা হবে একদিকে নীল নদ, অন্যদিকে ফোরাত নদী। অর্থাত্ মিসরকে হয়তো না পারলেও জর্ডানসহ ইরাকের একটা অংশ তারা চায়। একই সঙ্গে তারা সিরিয়া-লেবাননকে নিজেদের অংশ মনে করে। এটা তাদের দূরবর্তী স্বপ্ন।
ফিলিস্তিনের দুর্ভাগা জনগণের করণীয় কী?
তারা তো তাদের মাতৃভূমি হারাতে চায় না। সেক্ষেত্রে ইসরায়েল কি চাইলেই সব দখল করতে পারবে? আমি বলছি দুই কারণে তারা পারবে না। প্রথম কারণ হলো, তারা যদি ফিলিস্তিনের প্রত্যেককেই হত্যা করতে না পারে, তবে তারা হয়তো ফিলিস্তিনিদের জাতি হিসেবে স্বীকার করবে না; কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে স্বীকার করতে বাধ্য হবে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র না হলেও ইসরায়েলের ভেতরে তাদের থাকতে দিতে হবে। এখনো ইসরায়েলের ভেতরে ফিলিস্তিনিরা আছে এবং এ সংখ্যা নেহাত কম নয়। অনেকেই বলে থাকেন, আরবদের জন্মের হার ইহুদিদের তুলনায় বেশি। সুতরাং জনসংখ্যা হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে আরবরা। অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে কিছুই হয় না। পাকিস্তানে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল; কিন্তু তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না। কাজেই আমি বলব, ফিলিস্তিনিদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত, তাদের জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তারা প্রথমে যেটা ভুল করেছিল সেটা হলো, তারা জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত বিভাজনটা মানেনি। কেননা তারা বিশ্বশক্তির ভারসাম্যটা বুঝে উঠতে পারেনি। উল্লেখ্য খোদ রাশিয়াও তাদের বিরুদ্ধে ছিল। তবে পরবর্তীতে রাশিয়া তাদের পক্ষে থেকেও কোনো লাভ হয়নি।
এখন ভবিষ্যত্টা ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। আপাতত আমরা যেটা দেখছি তা হলো যে গণহত্যা চলছে, তা বিশ্ববিবেকের সামনে ঘটছে। অথচ জাতিসংঘ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এর প্রধান কারণ পরিষ্কার, ইসরায়েলের পক্ষে প্রধানশক্তি হিসেবে যত দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আছে, তত দিন পর্যন্ত ইসরায়েলকে উত্খাত করা সহজ হবে না। দুটি কারণে ইহুদিরা উত্খাত হতে পারে। বিখ্যাত দার্শনিক ওয়াল্টার বেনজামিন এটাকে বলতেন ডিভাইন ভায়োলেন্স। সেটাকে আমরা বলি আল্লাহর গজব। সেটা কি রকম হতে পারে— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থানে আছে, চিরকাল তা না-ও থাকতে পারে। তখন ইসরায়েলকে রক্ষা করবে কে? আর ইসরায়েল যদি নিজে মনে করে যে, সে নিজ বলে বা পারমাণবিক অস্ত্রের দৌলতে বিশ্বশক্তি হয়ে উঠবে, তাহলে ইসরায়েলের হাত থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করবে কে? অর্থাত্ তার সুইসাইড বোমা থেকে তাকে রক্ষা করবে কে? বলা যায় না, বর্তমান বিশ্বে দ্রুত প্রযুক্তির পরিবর্তন হচ্ছে এবং শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তিত হবে। ইসরায়েলের আগ্রাসনের প্রতিবাদে এরই মধ্যে ইকুয়েডর তার রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছে। ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও এটি এক ধরনের প্রতীকী প্রতিবাদ। আমি মনে করি, এ রকম প্রতিবাদ যদি সব আরব দেশ, এমনকি আমাদের মতো গরিব দেশগুলোও করতে পারত, তাহলে তা ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করত। আজকে ইসরায়েল যে কাজটি বেপরোয়াভাবে করতে পারছে, তার কারণ কেউ তাকে চাপ দিচ্ছে না। চীন-রাশিয়াও চুপ।
আরব দেশের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আরব দেশগুলোর ভূমিকাকে আমি প্রতিক্রিয়াশীল না বললেও বলব— সাবধানী। আরবদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করলেও কেউ কেউ সাবধানী ভূমিকা পালন করছে। যেমন— আরবদের মধ্যে লিবিয়া-ইরাক-সিরিয়া ফিলিস্তিনের পক্ষে ছিল। বর্তমানে তারা দূরবস্থায় আছে। লিবিয়া দক্ষিণপন্থীদের দখলে, ইরাক তো বিধ্বস্ত এবং সিরিয়া তো প্রায় বিধ্বস্ত। কাজেই তাদের কথা আসে না। আর আরবদের যে দেশগুলো কনজারভেটিভস, এগুলোয় ছিল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সরকার। সৌদি আরব, কাতার, কুয়েতের মতো রাজশক্তির দেশ; যেগুলো গালফ স্টেট নামে পরিচিতি, সেগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে মিত্রতা রক্ষা করেই চলে। তার কারণ হচ্ছে, তারা ইসরায়েলের প্রধান মুরব্বি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র।
এখন হয়তো ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়াতে পারত ইরান। কিন্তু দেশটি আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর মিসরে তো রাজনৈতিক পরিবর্তনের নানা ডামাডোল চলছে, যেটাকে আমরা আরব বসন্ত বলেছিলাম সেটাও এখন দুরবস্থার মধ্যে আছে। সেদিক থেকে আমি বলব, মধ্যপ্রাচ্য যে রাষ্ট্রশক্তিগুলো আছে, সেগুলো সামরিকভাবে দুর্বল। রাজনৈতিকভাবে তাদের অনেকেই হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ে ভীত, আবার অনেকেই দেশটির আশ্রয়ে আশ্রিত। এ অবস্থায় তারা ইসরায়েলকে তাদের মিত্র মনে করে এবং ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যে যে সমাজ বিপ্লব ঘটবে, তা ঠেকাতেই তারা ব্যস্ত। তারা মনে করে, সমাজ বিপ্লবের অগ্রদূত হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। সুতরাং ফিলিস্তিনে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র অন্তত শক্তিশালী জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হোক তা তারা চায় না।
আগে যে আরব যুদ্ধ হয়েছে। সেখানে আরবদের পরাজয়ের কারণ কি?
ইসরায়েলের সামরিক শক্তির পেছনে আছে দেশটির সাংস্কৃতিক শক্তি, বুদ্ধি ও বিজ্ঞানের শক্তি। ইসরায়েল হচ্ছে আসলে একটি ইউরোপীয় রাষ্ট্র; কেবল এর শারীরিক উপস্থিতি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। ইসরায়েলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ের জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে উন্নতি, বৈজ্ঞানিক এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক বিষয়ে তাদের যে উন্নতি, তা যুক্তরাষ্ট্রসহ যে কোনো ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সমান। তাহলে বলতে হবে, আরব রাষ্ট্রগুলো কি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে পারবে? এর প্রধান কারণ ছিল— আরব রাষ্ট্রগুলো ছিল ইউরোপের সেমি-কলোনি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এসব রাষ্ট্র কখনো স্বাধীন ছিল না। মাও সে তুংয়ের ভাষায় আধা-উপনিবেশ। আর ফিলিস্তিন-ইরাক-সিরিয়া এগুলো ৪০০ বছর ছিল ওসমানীয় সাম্রাজ্যের উপনিবেশ। ফিলিস্তিনের দুর্ভাগ্য তো আজকে শুরু হয়নি। এজন্য দায়ী তো আরবরাই। এজন্য দায়ী মুসলিমরাই। কারণ তুর্কী ওসমানীয় সাম্রাজ্য ফিলিস্তিনকে ৪০০ বছর শাসনের পর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ব্রিটেনের হাতে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছে। এটা হচ্ছে প্রথম মহাযুদ্ধের ফল এবং তখন থেকেই ইরাক-ফিলিস্তিন-জর্ডান পড়েছে ব্রিটেনের হাতে। আর সিরিয়া-লেবানন পড়েছে ফরাসিদের হাতে। তাদের বলা হতো ম্যান্ডেট। কিন্তু ফরাসিরা কলোনি ছেড়ে যাওয়ার সময় সিরিয়া ও লেবাননকে দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র করে দিয়ে গেছে। আর ব্রিটিশরা ইরাক ও জর্ডানকে স্বাধীন রাষ্ট্র করলেও ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের মাধ্যমে দ্বিখণ্ডিত করে ইসরায়েলের হাতে দিয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে ইউরোপ থেকে ইহুদিদের এনে সেখানে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তার পরও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারেনি। কেবল শক্তিগরিষ্ঠ হয়েছে।
আমি বলব, মধ্যপ্রাচ্যে যে ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়েছে, টাকা-পয়সায় তারা সবচেয়ে অগ্রণী। তারা সামরিক ও বুদ্ধির শক্তিতে সবচেয়ে অগ্রণী। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে আরব দেশে যে সামাজিক বিপ্লব সাধিত হওয়া দরকার তা হয়নি। কিন্তু আপনি উদাহরণ দিতে পারেন, মিসরে তো বিপ্লব হয়েছে। সেখানে ১৯৫২-৫৩ সালে সামরিক বাহিনীর একটি তরুণ অংশ ক্ষমতায় এসেছিল। তখন আলজেরিয়ায় বিপ্লব শুরু হয়েছে-১৯৫৪ সালে। আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ার স্বাধীনতা-সংগ্রামে মিসর কিছুটা সহায়তা করেছে। সেজন্য ফ্রান্স, ব্রিটেন ও ইসরায়েল মিলে সুয়েজ খালের নামে ১৯৫৬ সালে মিসরকে পরাজিত করে। আমেরিকা অন্তরালে থেকে মধ্যস্থতার ভান করেছে। দেশটি বলেছে, মিসরকে রক্ষার জন্য যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমেরিকা হলো ওই দেশগুলোর মিত্র। কেননা তারা ন্যাটোজোটভুক্ত। কাজেই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক থেকে সবচেয়ে বড় মিত্র হচ্ছে ইসরায়েল। সুতরাং ইসরায়েলকে পরাজিত করা মানে যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করা। সেটা আরব দেশগুলো সব একত্র হলেও পারবে না। আরব দেশগুলো যে একত্র হয় না তা তো আমরা জানি। শুধু তা-ই না, দেশগুলো পরস্পর পরস্পরকে যেভাবে শত্রু মনে করে, তা যুক্তরাষ্ট্র কিংবা কাউকে মনে করে না। একটি উদাহরণ দেয়া যাক— অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাস্ত করে ইংরেজরা বাংলা দখল করল। পরে ধীরে ধীরে তারা মারাঠাসহ দিল্লির শাসকদেরও পরাজিত করে। এটা কি করে সম্ভব হয়েছিল। এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের এবং ভারতের নবাবরা পরস্পরকে শত্রু মনে করতেন। অথচ তারা কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি ইংরেজরা এখানে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে।
আমার মনে হয় স্বাধীনতা হারিয়ে আমরা যেমন প্রজা হলাম, এ প্রক্রিয়াটি আরব দেশে এখনো সক্রিয়। এর অর্থ হলো, প্রত্যেকটি আরব দেশের পারস্পরিক যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তাদের সমাজ ব্যবস্থার যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তা সমানভাবে সক্রিয় আছে। আমরা আরব দেশ বলছি, কিন্তু এর ক্লাসটা দেখছি না। এর মধ্যে কিছু ফিউডাল স্টেট, কিছু প্রি-ফিউডাল স্টেট— এমনকি ট্রাইবাল স্টেটও আছে। এর পরও আমি বলছি, কিছু আরব নেতা দেশকে রাজতন্ত্র থেকে মুক্ত করার সংগ্রাম করেছিল। সোজা কথায়, আজকের আরব দেশের যে দুর্গতি তা অনেকটা অষ্টাদশ শতকের ভারতের দুর্গতির সঙ্গে তুলনীয়। যে কারণে আরব বিভক্ত, সে কারণেই ইসরায়েল শক্তিশালী।
গণমাধ্যমের ভূমিকাকে কীভাবে দেখেন?
গত কয়েক দিন আগে ফেসবুকে একটি গল্প পড়লাম— পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বুদ্ধিজীবী তারিক আলীর। তাকে বিবিসি ডেকে প্রথম দিন ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন— আপনাকে কি ফিলিস্তিন ইস্যুতে একটি সাক্ষাৎকারের জন্য শনিবার সকালে পাওয়া যাবে? তিনি বললেন হ্যাঁ। পরের দিন ফোন করে বলে— আপনি কি ইসরায়েলপন্থী কারো সঙ্গে তর্ক করতে রাজি আছেন? তিনি বললেন হ্যাঁ, রাজি আছি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ফোন করে তাকে বললেন— ওয়েলস অঞ্চলে একটি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে, সেজন্য আমরা প্রোগ্রামটা বাতিল করলাম। এটা তারিক আলী নিজেই লিখছেন। তাকে বিবিসি জিজ্ঞেস করেছিল— ফিলিস্তিন ইস্যুতে তিনি কি বলবেন? তিনি বললেন— আমি তিনটা কথা বলব। প্রথমত. ইসরায়েল একটি অপরাধী বা দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র, দ্বিতীয়ত. ইসরায়েল গাজায় যে গণহত্যা করছে তা নতুন নয়; তারা আগেও এটা করেছে। এখন কেবল একটা প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, এবার মাত্রাটা একটু বেশি অমানবিক। তৃতীয়ত. আপনারা বিবিসি, সিএনএন পশ্চিমা মিডিয়ারা ইসরায়েলের পক্ষে কথা বলছেন এবং আপনারা প্রকৃত অপরাধ দেখাচ্ছেন না। এ গল্পের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার পক্ষপাতটা সহজেই প্রকাশ পায়। আরো উদাহরণ দেয়া যাক— পশ্চিমারা দেখাচ্ছে এটা একটা যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে। কিন্তু তারা ফিলিস্তিনিদের যে একটা জাতিসত্তা আছে তা স্বীকার করছে না। প্রথমত. এটা যুদ্ধ নয়। আর যুদ্ধ হলেও বলব না এটি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ। মিডিয়ায় দেখলাম, গাজা জ্বলছে। যেন গাজা একটা আলাদা রাষ্ট্র। এটা তো ফিলিস্তিনের একটা ভূখণ্ড। ইসরায়েল তো সেখান থেকে কখনো সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করেনি; কেবল সামরিক বাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে সরিয়েছে। শুধু এটুকুই। কিন্তু সেখানে চেকপোস্টসহ রাস্তাঘাট দখলে রেখেছে এবং সেখান থেকে বসতি কখনো প্রত্যাহার করেনি। আসলে বর্তমান সংঘাতের মূল হচ্ছে দুই জায়গায়। এক. সবাই ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে বললেও ব্যাপারটা তা নয়। ইসরায়েল তার অধিকৃত বন্দিদের নির্যাতন করছে। ফিলিস্তিনিরা চিৎকার করছে; হাত-পা ছুড়ছে। তারা রকেট ছুড়ছে। এটা কোনো কাজের রকেট নয়। যেটা পুলিশি অ্যাকশন দিয়ে দমন করার জিনিস, সেটাকে ইসরায়েল সামরিক, নৌ এবং বিমানবাহিনী দিয়ে দমন করছে। যেখানে শুরু করেছিলাম মাহমুদ দরবেশের কবিতা দিয়ে— বালিকা/চিৎকার, সেখানেই ফিরে আসি। এ চিৎকারকে তারা বলছে যুদ্ধ। সে রক্ত দিচ্ছে আর চিৎকার করছে। এখন তারা সে চিৎকারটাও বন্ধ করতে চায়।
আমি বলতে চাই, ফিলিস্তিনিদের জাতীয় অধিকার ইসরায়েল এখনো স্বীকার করেনি। ইসরায়েলিরা তাদের রিফিউজি কিংবা অধিকৃত এলাকার মানুষ হিসেবেও স্বীকার করছে না। এত দিন স্বীকার করেছিল বলে মনে করেছিলাম। তাহলে এর সমাধান কি? আমি মনে করি, যতই ছোট হোক দুটি অবিচ্ছিন্ন ভূমির মধ্যে একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিতে হবে। গাজা ও পশ্চিম তীর দুটো মিলে ৬ হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটারের মতো এ ভূখণ্ডের মধ্যেও যে কেটে কেটে ইসরায়েল জমি নিয়ে নিচ্ছে, তা বন্ধ করতে হবে। অবিচ্ছিন্ন দুই টুকরা জমি পশ্চিমে গাজা এবং পূর্বে পশ্চিম তীর মিলে যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা এসেছিল, তা বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত সেখানে শান্তি আসবে না। কিন্তু ঐতিহাসিক ন্যায়ের খাতিরে বলা উচিত, গোটা ফিলিস্তিন এক রাষ্ট্র হওয়া উচিত ছিল এবং সেটা হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার রাষ্ট্র— যেখানে সব ধর্মের মানুষ বসবাস করতে পারে।
প্রকৃত অবস্থা হলো, ফিলিস্তিন এখন বিভক্ত। এখানে এখন একটি ইহুদি রাষ্ট্র, আরেকটি গণতান্ত্রিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে; সেটা কোনোভাবেই মুসলিম রাষ্ট্র নয়। এখানে প্রায় মানুষ একটা ভুল করে। ইহুদি একটি ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্র সত্য; কিন্তু ফিলিস্তিন কখনো ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্র হবে না। ফিলিস্তিনের নেতারা কখনো ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্রের কথা বলেননি। ফিলিস্তিনে এখন যে গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে তা হলো, হামাস যে রাষ্ট্রের কথা বলছে তা কেবল মুসলিম রাষ্ট্র হবে না; উপরন্তু এটা হবে ইসলামী রাষ্ট্র। এটা হচ্ছে হামাসের প্রোগ্রাম। হামাস এখন তা না বললেও তার পেটের মধ্যে তা আছে। কারণ দলটি মুসলিম ব্রাদারহুডের অংশ। এ জায়গাটি হলো ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক পরাজয়। ফিলিস্তিন যদি মুসলিম কিংবা ইসলামী রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়, তাহলে সেটি হবে দেশটির ঐতিহাসিক পরাজয়। কেননা ফিলিস্তিনের চিরন্তন ঐতিহ্য হচ্ছে সেক্যুলারিজম। আমি সেক্যুলারিজম কথাটা কোনো তাত্ত্বিক অর্থে বলছি না, ঐতিহাসিক অর্থে বলছি। খ্রিস্টান, মুসলিম ও ইহুদিদের সহাবস্থানকে আমি এখানে বলছি জাতীয় দিক থেকে রিপাবলিকান, গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার। এ তিন শব্দ আমার কাছে প্রায় সমার্থক। আর ফিলিস্তিন যদি দৈহিকভাবে একটি রাষ্ট্র পায়-ও এবং সে রাষ্ট্র যদি ধর্মতাত্ত্বিকভাবে চালাতে হয়, সেটিও হবে তার পরাজয়। ইসরায়েলের হাতে মার খাওয়া শারীরিক পরাজয় হলেও হামাস যেদিকে নিতে চাচ্ছে, সেদিকে গেলে সেটি হবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের মানসিক পরাজয়।
অনুলিখন : হুমায়ুন কবির
[বণিক বার্তা, জুলাই ২৬, ২০১৪ থেকে সংগৃহিত]