জামায়াতের বিরুদ্ধে সাক্ষী ছিলেন ফারুকী
প্রকাশিত হয়েছে : ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ১০:২৬ পূর্বাহ্ণ
অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার মামলার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী। এই সংগঠনের বিরুদ্ধে সাক্ষীদের নামের তালিকাটি ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটার থেকে গোপনে কপি হয়ে গেছে। জুন মাসের শেষ ভাগে সাক্ষীদের নামের তালিকা কপি হওয়ার ৭০ দিন পর ২৭ আগস্ট সন্ধ্যায় রাজারবাগের বাসায় খুন হন নুরুল ইসলাম ফারুকী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ এ প্রসঙ্গে বলেন, জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ইসলামিক চিন্তাবিদ মাওলানা ফারুকী স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ফারুকীসহ যাদের নামের তালিকা তৈরি হয়েছিল তা কে বা কারা কম্পিউটার থেকে কপি করে নিয়ে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, ‘আমি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও বলেছি যে, এই কম্পিউটারে আমার রিসার্চের বিভিন্ন কপি আছে। অন্যান্য আর্গুমেন্টের কপি ছিল যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয়। এগুলো পাবলিক ডকুমেন্ট। সব আদালতে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে- এখানে অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার মামলায় সম্ভাব্য সাক্ষীদের নাম ছিল। যেখানে ফারুকীর নামও ছিল।’
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ফারুকী খুনের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে ওই জিডির ঘটনাটিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম বলেন, সব বিষয় মাথায় রেখে ফারুকী হত্যার তদন্ত চলছে। এতে করে শাহবাগ থানায় করা ওই জিডির সূত্রটি কাজে লাগানো হচ্ছে। এর ভেতরে কোনো ক্লু লুকিয়ে আছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা টিম।
অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিষয়টি বর্তমানে ঝুলে আছে। তদন্ত রিপোর্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়ার পর থেকেই এই মামলায় কে বা কারা সাক্ষী হবেন তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা কাজ শুরু করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ সাক্ষীদের সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করেছিলেন। তালিকাভুক্ত ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মত ছিলেন তাদের নামেরও তালিকা ছিল। ওই তালিকায় ছিল মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর নাম। সেখানে আরও যাদের নাম ছিল নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা হল না। ট্রাইব্যুনালের অফিস কক্ষে ব্যবহৃত কম্পিউটারে এ ধরনের তালিকা তৈরির কাজ করেন তিনি। কাজ শুরুর পর এক পর্যায়ে তিনি কয়েক দিনের ছুটিতে যান। ছুটি থেকে ফেরার পর ওই কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের সংযোগ বিচ্ছিন্ন দেখতে পান। এতে ক্ষতির আশংকায় তিনি রাজধানীর শাহবাগ থানায় ২২ জুন একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডি নম্বর ১১৯৬। পুলিশকে গুরুত্বের সঙ্গে তদন্তের অনুরোধ করলেও রহস্যজনক কারণে কাজ এগোয়নি।
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ আরো বলেন, ‘কম্পিউটারে যে তথ্য ছিল সেখানে মাওলানা ফারুকী ও ইসলামিক আরও কয়েকজন ফিলোসোফারসহ ৮০ থেকে ৯০ সাক্ষীর নাম ছিল।’ অনেকে এ মামলায় সাক্ষ্য দিতে চাননি। তিনি অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তারা একবাক্যে বলেছেন- ‘তারা সাক্ষ্য দেবেন না।’ এ ধরনের নামও ওই তালিকায় আছে।
জিডিতে ছিল ভয়ানক ক্ষতির আশংকা : ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ তার জিডিতে উল্লেখ করেন ‘আমি প্রসিকিউটর কার্যালয়ের ৯নং কক্ষ অফিস হিসেবে ব্যবহার করে আসছি। আমার অফিসের কাজে আমি নিজের দায়িত্বাধীনে একটি কম্পিউটার ও একটি প্রিন্টার ব্যবহার করে আসছি। কম্পিউটারে আমার নিজস্ব পাসওয়ার্ড সংরক্ষিত। গত ১৫ থেকে ১৯ জুন আমি ছুটিতে ছিলাম। ছুটি শেষে ২২ জুন অফিসে যোগদান করে আমার কম্পিউটর ও প্রিন্টারসহ সরঞ্জামাদি এলোমেলো অবস্থায় দেখতে পাই। তখন আমি অফিস সহায়ক (এমএলএসএস) আশিক ও হারুনসহ কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করি। আশিক আমার ও অন্যদের উপস্থিতিতে সিপিউর হার্ডডিস্কসহ সব তার খোলা পায়। এতে ধারণা হয়, আমার অনুপস্থিতিতে অজ্ঞাতে কে বা কারা কম্পিউটার থেকে তদন্তের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি, মামলার কাগজপত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি কপি নিয়ে যেতে পারে। যার ফলে চলমান মামলা বা ভবিষ্যতে এই অফিসের কোনো ভয়ানক ক্ষতি সাধিত হতে পারে এবং বিচারাধীন মামলাসমূহ প্রভাবিত হতে পারে। তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অতীব জরুরি।’ ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজের এই জিডিতে ভয়ানক ক্ষতি সাধিত হতে পারে বলে আশংকা করা হয়। কারণ, তিনি জানতেন ওই হার্ডডিস্কে স্পর্শকাতর বিচারাধীন মামলার তথ্য আছে। যেখানে সম্ভাব্য সাক্ষীদের তালিকা ছিল বলে তিনি শংকা প্রকাশ করেছিলেন।
টার্গেট কিলিংয়ের আশংকা : অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি সূত্র জানায়, কয়েকটি ক্যাটাগরিতে সাক্ষীদের তালিকা করা হয়। এর মধ্যে শিক্ষাবিদ, ইসলামিক ফিলোসোফার, মসজিদের ইমাম, বীরাঙ্গনা, মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখযোগ্য। ইসলামিক ফিলোসোফার ক্যাটাগরিতে অন্যতম তালিকায় ছিলেন মাওলানা ফারুকীর নাম। অবশ্য ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ যুগান্তরের কাছে শংকা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে টার্গেট কিলিংয়ের আশংকা প্রকাশ করেছিলাম। কারণ এখানে ৮০ থেকে ৯০ জন সাক্ষীর নাম ছিল। আর ফারুকী ইসলামিক ফিলোসোফার ক্যাটাগরিতে সাক্ষী দিতে রাজি হয়েছিলেন। তার মতো আরও কয়েকজন সাক্ষী দিতে প্রস্তুত আছেন। আমি তাদের সঙ্গে হিজাব পরিধান করে গিয়ে কথা বলেছি। তারা হিজাব পরা ছাড়া আমার সঙ্গে কথা বলতেন না। ফারুকীর ক্যাটাগরিতে আরও কয়েকজন ইসলামিক ফিলোসোফার সাক্ষী দিতে রাজি হন।’
হার্ডডিস্ক পড়ে আছে : গুরুত্বপূর্ণ এই জিডির তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের চার নম্বর টিমের ইন্সপেক্টর ফজলুর রহমান জানান, তিনি জব্দ তালিকার মধ্যে থাকা হার্ডডিস্ক পরীক্ষার জন্য সিআইডির বিশেষজ্ঞ দলের কাছে পাঠিয়েছেন। তিনি ধারণা করছেন, কেউ হয়তো তথ্য চুরি করতে কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক খুলেছিল। বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন ।
কোনো অগ্রগতি নেই : ২২ জুন জিডি দায়ের হলেও এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। শুধু ঘটনার পর থানা পুলিশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য বের করতে পারেনি থানা পুলিশ। পরে জিডির ঘটনাটি গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু গোয়েন্দা পুলিশও বিষয়টি নিয়ে বেশিদূর এগোতে পারেনি।
জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর ফজলুর রহমান বলেন, সিআইডি থেকে চুরি ও কপি করার কোনো তথ্য তাকে এখনও জানানো হয়নি। তাই তিনি এ নিয়ে অগ্রসর হতে পারছেন না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিডির সূত্র ধরে গভীরভাবে তদন্ত করা হলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসত।
অনেক প্রশ্ন : জিডির বাদী ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনায় বিশেষজ্ঞ দিয়ে তদন্ত টিম গঠন করা উচিত ছিল। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, কেউ কি তদন্তকারীদের চাপে রেখেছে? স্পর্শকাতর এই ঘটনাটির সঙ্গে কারা জড়িত এটি বের করতে তদন্ত সংস্থা সময় নিচ্ছে কেন। তাছাড়া হার্ডডিস্কের কানেকশনের তার যেহেতু খোলা ছিল তাই এটি কারা খুলতে পারে সম্ভাব্য সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এর রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব। কিন্তু এসব না করার পেছনে কি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করেন তুরিন আফরোজ।
জিডির সূত্র ধরেও তদন্ত : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজের দায়ের করা জিডির সূত্র ধরে ফারুকী খুনের ঘটনা তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তারা অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তদন্তে এই জিডিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। সূত্র জানায়, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে সাধারণত পেশাদার খুনিরা অংশ নেয়। তারা হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরের বিষয়গুলো কি হতে পারে সে বিষয়ে ধারণা রাখে। ফারুকী হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তারা ক্লু মুছে ফেলতে চেয়েছে। কিন্তু অপরাধ বিজ্ঞানে আছে, যে অপরাধ করে সে কিছু না কিছু ক্লু রেখে যায়। আবার ক্লু হয়তো কোনো আগের ঘটনার সূত্রও হতে পারে। আগের সূত্র হিসেবে সেই জিডির সূত্রকেও কাজে লাগাচ্ছে ডিবি পুলিশ।
প্রথম টার্গেট কি ফারুকী : ডিবি পুলিশের তদন্ত সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডে যেই অংশ নিক না কেন এ ঘটনার নেপথ্যের কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সেটা রাজনৈতিক বা আদর্শিক কারণও হতে পারে। তাছাড়াও শাহ্বাগ থানার জিডির ঘটনার সূত্রকেও কাজে লাগানো হচ্ছে। এ খুনে উগ্রপন্থীরা জড়তি থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। জিডির বিষয়টি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা পর্যালোচনা করছেন। পাশাপাশি কম্পিউটারে যে তথ্যগুলো ছিল সেখানে ফারুকীর নাম অন্যতম তালিকায় ছিল। এ বিষয়টিও গুরুত্ব দিচ্ছেন কর্মকর্তারা। তাই এই জিডি আমলে নিয়ে গুরুত্ব সহকারে এর নেপথ্যে যাওয়ার চেষ্টা করছে গোয়েন্দারা।
তদন্ত সূত্র জানায়, তালিকায় থাকা ফারুকী হয়তো উগ্রপন্থী বা গোষ্ঠীর টার্গেটে পরিণত হয়। তাকে দিয়েই হয়তো কিলিং মিশন শুরু করেছে। এর ফলে অন্যদের আতংকে রাখার পথ বেছে নিয়েছে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। অপর একটি সূত্র জানায়, আবার কোনো তৃতীয় গ্র“প এর সুবিধা নিয়ে জামায়াতের ওপর দোষ চাপাতে পারে।
যুগান্তরের সৌজন্যে ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪